সর্বশেষ

বিনিয়োগে ধাক্কা, অর্থনীতিতে মন্দা

বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা

প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২৫, ২০:৪৬
বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা

বাংলাদেশের অর্থনীতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বড় ধাক্কা খেয়েছে—এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে বিশ্বব্যাংকের সদ্য প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন হালনাগাদ প্রতিবেদন’-এ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলন, উচ্চ সুদের হার, লাগামহীন মূল্যস্ফীতি এবং ব্যাংক খাতের অস্থিতিশীলতায় অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।

 

বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের ৪.২ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে, যা গত এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধীরগতি শুধু প্রবৃদ্ধি নয়—বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভাবনাকেও গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

 

বিনিয়োগ স্থবির, ব্যাংক খাত অস্থির

 

প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক জটিলতায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসে এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ব্যাপকভাবে কমে যায়। ফলে নতুন শিল্প ও উৎপাদন প্রকল্পে বিনিয়োগ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।

 

উচ্চ সুদের হার, ব্যয়বহুল কাঁচামাল এবং অনিশ্চিত মুদ্রানীতি ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি নিতে নিরুৎসাহ করেছে। এতে বিনিয়োগ স্থবিরতা প্রবৃদ্ধিকে টেনে নামিয়েছে, বলছে প্রতিবেদনটি।

 

 

অন্যদিকে, ব্যাংক খাতে অস্থিতিশীলতা অর্থনীতির দুর্বলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী হিসাব করলে, ২০২৫ সালের মার্চ নাগাদ ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ২৪.১ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের তিন গুণেরও বেশি। মূলধনঝুঁকি অনুপাত নেমে এসেছে ৬.৩ শতাংশে—ন্যূনতম নিয়ন্ত্রক মান ১০ শতাংশের নিচে।

 

এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার নতুন ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ’ জারি করেছে, যা অদক্ষ ব্যাংক পুনর্গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে কিছুটা স্বস্তি

 

তবে সার্বিক মন্দার মধ্যেও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৮.৮ শতাংশ, যার মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক, চামড়া, প্লাস্টিক ও কৃষিপণ্য খাত। প্রবাসী আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—২৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেয়ে ইতিহাসের অন্যতম উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

 

এই দুই খাতের ইতিবাচক প্রভাবেই অর্থনীতি পুরোপুরি সংকটে না পড়ে কিছুটা স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে পেরেছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

 

কর্মসংস্থান ও উৎপাদনে ধস

 

কৃষি খাত বছরের শেষ ভাগে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও শিল্প ও নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল স্বাভাবিকের নিচে। সেবা খাতেও মন্দাভাব অব্যাহত—বিশেষ করে বাণিজ্য, পরিবহন ও আবাসন খাতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে।

 

২০২৪ সালে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬০.৯ শতাংশ, যা ২০২৫ সালে নেমে এসেছে ৫৮.৯ শতাংশে। নারীদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় মোট কর্মসংস্থান অনুপাত ২.১ শতাংশ কমে ৫৬.৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে ৩.৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

 

রাজস্ব ঘাটতি ও ঋণনির্ভরতা বাড়ছে

 

কর আদায় জিডিপির অনুপাতে ৭.৪ শতাংশ থেকে কমে ৬.৮ শতাংশে নেমেছে। অপরদিকে ভর্তুকি ও সুদের ব্যয় বেড়ে বর্তমান ব্যয় দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৯.২ শতাংশে। উন্নয়ন ব্যয় কমে এসেছে ৩.৩ শতাংশে, ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে হয়েছে ৪.৭ শতাংশ।

 

সরকার রাজস্ব সংস্কারে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে—যেমন কর নীতি ও প্রশাসনের পৃথককরণ, কর অব্যাহতি সংস্কার এবং বাধ্যতামূলক অনলাইন রিটার্ন দাখিল। তবুও সরকারি ঋণ জিডিপির অনুপাতে আরও ভারী হয়েছে, যার প্রায় ৩৭ শতাংশ এখন ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হচ্ছে।

 

বহিঃখাতে অস্থায়ী ‘ইতিবাচকতা’

 

রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণে আট বছর পর বাংলাদেশ চলতি হিসাব উদ্বৃত্তে এসেছে—১৪৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে আমদানি কাঠামোয় বৈষম্য রয়ে গেছে: খাদ্য ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি বেড়েছে, কিন্তু মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা ভবিষ্যৎ বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 

বিশ্বব্যাংকের মতে, ২০২৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৪.৮ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে এবং ভোগব্যয় বাড়লে চাহিদা পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা, জ্বালানি ঘাটতি এবং সংস্কার বিলম্ব আগামী বছরেও অর্থনীতির জন্য বড় বাধা হয়ে থাকবে।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ ও ভুটানবিষয়ক পরিচালক জ্যাঁ পেসমে বলেছেন,

 

বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিস্থাপকতা দেখিয়েছে, কিন্তু এটি স্বাভাবিক ধরে নেওয়া যাবে না। কর আদায় বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করা, জ্বালানি ভর্তুকি হ্রাস এবং বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের সংস্কার এখন অপরিহার্য।

সব খবর

আরও পড়ুন

‘সহজক্যাশ’ নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানে লেনদেনে সতর্কতা জারি করলো বাংলাদেশ ব্যাংক

‘সহজক্যাশ’ নামে ভুয়া প্রতিষ্ঠানে লেনদেনে সতর্কতা জারি করলো বাংলাদেশ ব্যাংক

চার বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ, শ্রমবাজারে বিপর্যয়

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস চার বছরের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সর্বোচ্চ, শ্রমবাজারে বিপর্যয়

আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির প্রভাবে বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে

আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির প্রভাবে বাংলাদেশে বেকারত্ব বাড়ছে

সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৬৬ শতাংশ, সামগ্রিক রপ্তানি আয় হ্রাস ৪.৬১ শতাংশ

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপে ধাক্কা সেপ্টেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫.৬৬ শতাংশ, সামগ্রিক রপ্তানি আয় হ্রাস ৪.৬১ শতাংশ

বৃষ্টির অজুহাতে সবজির বাজারে আগুন, মরিচ-বেগুনে ক্রেতার হাঁসফাঁস

বৃষ্টির অজুহাতে সবজির বাজারে আগুন, মরিচ-বেগুনে ক্রেতার হাঁসফাঁস

একীভূত হচ্ছে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক: গ্রাহকের টাকা কতটা নিরাপদ?

একীভূত হচ্ছে পাঁচ ইসলামী ব্যাংক: গ্রাহকের টাকা কতটা নিরাপদ?

নাসা গ্রুপের ১৬ কারখানা বন্ধ, ৩০ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

নাসা গ্রুপের ১৬ কারখানা বন্ধ, ৩০ হাজার শ্রমিকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত

আগাম নোটিশ ছাড়াই ২০০ কর্মী ছাঁটাই, ৪৯৭১ কর্মকর্তা ওএসডি

ইসলামী ব্যাংকে নজিরবিহীন অভিযান আগাম নোটিশ ছাড়াই ২০০ কর্মী ছাঁটাই, ৪৯৭১ কর্মকর্তা ওএসডি