বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার চলতি বছরে চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ অনুসারে, ২০২৫ সালে দেশের দারিদ্র্যের হার দাঁড়াতে পারে ২১ দশমিক ২ শতাংশে, যা গত বছরের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
বিশ্বব্যাংক বলছে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দারিদ্র্য কমেনি, বরং ধীরে ধীরে বেড়েছে। ২০২২ সালে এ হার ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২৩ সালে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, আর ২০২৪ সালে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। চলতি বছর তা চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও কর্মসংস্থানের সংকট এই দারিদ্র্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ। ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে—অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, যার মধ্যে ২৪ লাখই নারী।
এতে কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত ৫৮ দশমিক ৮ থেকে কমে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
তবে সংস্থাটি আশা প্রকাশ করেছে, ২০২৬ সালে দারিদ্র্যের হার ১৯ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২৭ সালে ১৮ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসতে পারে—যদি সরকার পরিকল্পিত সংস্কারগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে জানিয়েছে, এই পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অত্যন্ত নাজুক। এর সাফল্য নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—সংস্কার বাস্তবায়নের গতি, ব্যাংক খাতের পুনর্গঠন, এবং দেশীয়-বৈদেশিক অর্থনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতা।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে। তবে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসলে ২০২৭ সালের মধ্যে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগোবে এবং বেসরকারি বিনিয়োগ ও ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র্য বৃদ্ধির এ তথ্য অমূলক নয়। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের ঘাটতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। চাকরির সুযোগ কমে গেছে, ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনমান আরও নিচে নেমেছে।”
একইভাবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সহসভাপতি ড. সাদিক আহমেদ মনে করেন, “দেশে বেকার ও অর্ধবেকার শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।”
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফ্রানজিস্কা ওনসর্জ বলেন, “বাংলাদেশ যদি উন্মুক্ত বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহার বাড়াতে পারে, তবে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।”
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে দারিদ্র্যের প্রবণতা আরও বাড়বে।