বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই কোচিংনির্ভর হয়ে উঠছে। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একাডেমিক কোচিং এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলোর সংগঠন সূত্রে জানা যায়, বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা এই খাতে লেনদেন হয়। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এডুকেশন কমিউনিকেশনের জরিপে বলা হয়েছে, প্রকৃত অঙ্ক আরও বেশি—৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। অন্যদিকে এডুকেশন রিসার্চ কাউন্সিলের দাবি, বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার কোচিং-বাণিজ্য হয়।
সন্তানদের শিক্ষার জন্য অভিভাবকদের এই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে কোচিং ফি বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। অভিযোগ রয়েছে, অনেক শিক্ষক ক্লাসে বিষয়বস্তুর অর্ধেক শেখান, ফলে শিক্ষার্থীরা কিছুই বোঝে না। কোচিং না করলে নম্বর কম দেওয়া বা ফেল করিয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। এমনকি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগও আছে।
অতিরিক্ত পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতার কারণে শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে ঝুঁকছে। বর্তমানে প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী কোচিংনির্ভর। রাজধানীতে ৫ হাজারের বেশি কোচিং সেন্টার চালাচ্ছেন নামিদামি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা। শুধু একাডেমিক নয়, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তিতেও কোচিং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এই খাতে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়। ভর্তি সহায়ক বইয়ের বাজারও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, যার অর্ধেক বিক্রি করে কোচিং সেন্টারগুলো।
দেশে নিবন্ধিত কোচিং সেন্টারের সংখ্যা ৬,৫৮৭ হলেও নিবন্ধনহীন সেন্টার রয়েছে প্রায় ২ লক্ষাধিক। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান থেকে অনুমোদন পাওয়া যায়, ফলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো তদারকি নেই। ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের কোচিং ব্যবসা বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে, যা ২০১৯ সালে গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “শিক্ষায় বড় সংস্কার দরকার। শিক্ষাকে ক্লাসমুখী করতে হবে। শিক্ষকরা যাতে ক্লাসে ভালোভাবে পড়ান, সেই ব্যবস্থা করতে হবে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক বলেন, “কোচিং সেন্টারগুলো এখন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। নিবন্ধন ও মনিটরিং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা উচিত।”
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার রয়েছে ৩৩টি, মেডিক্যালে ১৩টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি। এছাড়া ১৯টি একাডেমিক কোচিং, ১৩টি চাকরির কোচিং, ভাষা শেখার জন্য প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠান এবং ক্যাডেট ও বিশেষায়িত কোচিং মিলিয়ে শতাধিক সেন্টার সক্রিয়।
উদ্ভাস কোচিং সেন্টারে এ বছর প্রায় ২০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন। ভর্তি ফি ১৫ হাজার থেকে ১৮,৫০০ টাকা। ইউসিসি কোচিং সেন্টারে ঢাকার প্রধান অফিসে অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছেন, যেখানে ফি ১২ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা পর্যন্ত। বিসিএস ওরাকল কোচিং সেন্টারে গড়ে ১০ হাজার টাকা ফি নেওয়া হচ্ছে।
কোচিং মালিকরা দাবি করেন, “শিক্ষকরা ক্লাসে পড়ান না বলেই শিক্ষার্থীরা কোচিংয়ে আসে। আমরা কাউকে বাধ্য করছি না।” তারা নীতিমালার প্রয়োজন স্বীকার করে বলেন, এতে প্রতারণামূলক কোচিং বন্ধ হবে।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। রাজধানী থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠছে। মানহীন শিক্ষকরা অনেক জায়গায় পাঠদান করছেন। ফলে শিক্ষার্থীরা কোচিং ছাড়া ভালো ফলাফল করতে পারছে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্লাসমুখী করা এবং শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সামাজিক সম্মান বাড়ানো ছাড়া এই প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়।