জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে আবশ্যিক কোর্স কাঠামোয়। প্রথম বর্ষের সব স্নাতক (সম্মান) ও পেশাগত স্নাতক প্রোগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে পড়ানো ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস’ বিষয়টি বাদ দিয়ে তার পরিবর্তে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন একটি কোর্স—‘বাংলাদেশের ইতিহাস: ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়’।
এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে শিক্ষাঙ্গন ও সামাজিক পর্যায়ে নানা প্রশ্ন ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে; বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৫ মাসে বারংবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুন্ঠিত করা, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সংক্রান্ত নানা বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম উন্নয়ন ও মূল্যায়ন কেন্দ্র মঙ্গলবার যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, তাতে বলা হয়, প্রফেশনাল অনার্সের প্রথম বর্ষের বিএসসি (এএমটি, এফডিটি, কেএমটি, টিএসটি), বিবিএ (অনার্স) প্রফেশনাল, ইসিই, সিএসই, মেরিন ফিশারিস, মেরিন নটিক্যাল, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, ড্রামা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, বিএফএ, বি-মিউজিক এবং বিএড বিভাগের শিক্ষার্থীরা আর ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস’ পড়বে না। এর পরিবর্তে কোর্স কোড ২১৯৯০১-‘বাংলাদেশের ইতিহাস: ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়’ বিষয়টি আবশ্যিক করা হয়েছে।
এর আগে ৬ নভেম্বর জারি করা আরেক প্রজ্ঞাপনে স্নাতক (সম্মান) প্রোগ্রামের সব বিষয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও একই কোর্স আবশ্যিক করার ঘোষণা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, নতুন কোর্সটি পড়াবেন ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, নৃবিজ্ঞান এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষকরা।
তবে এই পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনা বাড়ছে। শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মনে করছেন ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস’ কোর্সটি শুধু একাডেমিক নয়; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির আত্মপরিচয় এবং রাষ্ট্রগঠনের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এ সময়ে এসে সেটি বাদ দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে দুর্বল করার প্রচেষ্টার অংশ কিনা এ প্রশ্নও উঠেছে। গত ১৫ মাসে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করার নানা প্রচেষ্টাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে অনেকেই বলছেন, নতুন সিদ্ধান্তটি আরও সন্দেহ উসকে দিচ্ছে।
নতুন কোর্সে মুক্তিযুদ্ধের অংশ কীভাবে উপস্থাপিত হবে, অথবা এটি কি পূর্বের কোর্সের মতোই স্বাধীনতার ইতিহাসকে গুরুত্ব দেবে কিনা এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যাখ্যা এখনও পাওয়া যায়নি। মঙ্গলবার ও বুধবার কারিকুলাম উন্নয়ন কেন্দ্রের ডিন অধ্যাপক এ এইচ এম রুহুল কুদ্দুস এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ এস এম আমানুল্লাহর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
এদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাদ দিয়ে ‘পরিচয়’–কেন্দ্রিক কোর্স চালু করা কি আদৌ প্রয়োজন ছিল, নাকি এটি বৃহত্তর কোনো নীতিগত পরিবর্তনের অংশ? জাতির আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি—১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ—এখন কি পাঠ্যক্রমের প্রান্তে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে?