সর্বশেষ

পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের জরিপ

প্রাথমিক পেরোনো শিক্ষার্থীর অর্ধেকও পৌঁছায় না দশম শ্রেণিতে

প্রকাশিত: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৯:৩০
প্রাথমিক পেরোনো শিক্ষার্থীর অর্ধেকও পৌঁছায় না দশম শ্রেণিতে

বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করা শিশুদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি হলেও মাধ্যমিক স্তরে পৌঁছানোর আগেই অনেকেই ঝরে পড়ে। নতুন এক সরকারি জরিপে দেখা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ৮৪ শতাংশ শিশু, কিন্তু মাত্র ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছায়।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে–২০২৫’ এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর এক বছরের বেশি সময় ধরে এই জরিপ করা হয়। এতে দেখা যায়, নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা, বিশেষ করে মেয়েরা, মাধ্যমিক শেষ করার আগেই স্কুল ছাড়ে। তবে নিম্ন মাধ্যমিকে (৬ষ্ঠ–৮ম শ্রেণি) ছেলেদের ঝরে পড়ার হার বেশি।

 

জরিপ অনুযায়ী, নিম্ন মাধ্যমিক শেষ করার হার ছেলে শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ৭৬ শতাংশ। কিন্তু নবম ও দশম শ্রেণি পর্যন্ত পৌঁছাতে গিয়ে এই হার আরও কমে যায়।  

 

বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) জানায়, দেশে বর্তমানে ১৮ হাজার ৯৬৮টি মাধ্যমিক স্কুলে মোট ৮১ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তবে শিক্ষাবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট ও শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শেষ করার আগেই স্কুল ছাড়ছে।  

 

ক্যাম্পেইন ফর পপুলার এডুকেশন (ক্যাম্প) সংস্থার নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, “এই অবস্থা উদ্বেগজনক। অন্যান্য গবেষণাতেও একই ধরনের পতনের প্রবণতা দেখা গেছে।” তার মতে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্যবিয়ে এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে শ্রমবাজারে প্রবেশ দুই কারণেই ঝরে পড়া বাড়ছে। দরিদ্র পরিবারগুলোতে ছেলেদের আয়-রোজগারের চাপ বেশি, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে পরিবারগুলো বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চায়।  

 

তিনি আরও বলেন, মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার পদ্ধতি আকর্ষণীয় না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আগ্রহ হারায়। অনেক স্কুল বেসরকারিভাবে পরিচালিত হওয়ায় মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।  

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “আগেভাগে স্কুল ছাড়ার কারণে দেশ দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক, অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষাবঞ্চিত হচ্ছে। দুই, তারা ভালো কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ তাদের জন্য উপযুক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণের কর্মসূচি নেই।”  

 

জরিপে দেখা গেছে, সব বিভাগেই প্রাথমিক থেকে নিম্ন মাধ্যমিক এবং তারপর উচ্চ মাধ্যমিকে যেতে যেতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষ করার হার ধীরে ধীরে কমছে।  
 

- প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ৮৩.৭ শতাংশ  
- নিম্ন মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ৬৯.৩ শতাংশ  
- উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে মাত্র ৪৩.৯ শতাংশ  
 

দরিদ্র পরিবারের মাত্র ২১ শতাংশ শিশু নবম–দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে, যা জাতীয় গড়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ পয়েন্ট কম। বিপরীতে সচ্ছল পরিবারের প্রায় ৬৬ শতাংশ শিশু এই পর্যায়ে পৌঁছায়। শহরে দশম শ্রেণি শেষ করার হার ৪৯ শতাংশ, গ্রামে তা ৪২ শতাংশ।  

 

সিলেটে নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় স্তরে শিক্ষার্থীদের স্কুল শেষ করার হার সবচেয়ে কম। ঢাকায় প্রাথমিক পাস করে ৮১.৬ শতাংশ, কিন্তু দশম শ্রেণি শেষ করে মাত্র ৪২.৭ শতাংশ।  

 

প্রাথমিক স্তরে উপস্থিতি ৮৪.৩ শতাংশ হলেও নিম্ন মাধ্যমিকে তা কমে ৫৯.৬ শতাংশে এবং উচ্চ মাধ্যমিকে মাত্র ৫০.৫ শতাংশে নেমে আসে। সিলেটে উচ্চ মাধ্যমিকে উপস্থিতি সবচেয়ে কম—মাত্র ৪৪ শতাংশ।  
 
রাশেদা কে চৌধুরীর মতে, শিক্ষার্থীদের স্কুলে রাখতে হলে পড়াশোনাকে আরও আকর্ষণীয় করতে হবে। তিনি বলেন, “ভালো শিক্ষক তৈরি করতে এবং শিক্ষাকে আনন্দদায়ক করতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ প্রয়োজন।” শিক্ষাবিদরা বারবার আহ্বান করলেও সরকারি বাজেট ধারাবাহিকভাবে কমছে। শিক্ষার মান বাড়াতে হলে বাজেট বাড়ানো জরুরি।  

 

জরিপের ফলাফল স্পষ্ট করেছে, প্রাথমিক শিক্ষায় অগ্রগতি হলেও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সংকট, বাল্যবিয়ে, শ্রমবাজারে আগাম প্রবেশ এবং শিক্ষার মানের দুর্বলতা মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, মানসম্মত শিক্ষা, পর্যাপ্ত বাজেট এবং আকর্ষণীয় শিক্ষণপদ্ধতি ছাড়া এই প্রবণতা থামানো সম্ভব নয়।

সব খবর

আরও পড়ুন

আজ থেকে মাউশিতে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচিতে যাচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডাররা

আজ থেকে মাউশিতে অনির্দিষ্টকালের অবস্থান কর্মসূচিতে যাচ্ছেন শিক্ষা ক্যাডাররা

বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার কোচিং-বাণিজ্য

শিক্ষা যেন বাণিজ্যিক পণ্য বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার কোচিং-বাণিজ্য

‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস’ বাদ, প্রশ্ন উঠছে উদ্দেশ্য নিয়ে

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন আবশ্যিক কোর্স ‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাস’ বাদ, প্রশ্ন উঠছে উদ্দেশ্য নিয়ে

ইউনূস সরকারের ব্যর্থতায় মার্চের আগে সব বই পাবে না ১ কোটির বেশি শিক্ষার্থী

ঝুঁকিতে শিক্ষাজীবন ইউনূস সরকারের ব্যর্থতায় মার্চের আগে সব বই পাবে না ১ কোটির বেশি শিক্ষার্থী

৩৭ সরকারি মেডিকেলে এমবিবিএস আসন পুনর্বিন্যাস

কমলো ৩৫৫, বাড়লো ৭৫ ৩৭ সরকারি মেডিকেলে এমবিবিএস আসন পুনর্বিন্যাস

তিন দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি চলমান

প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন তিন দফা দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি চলমান

বন্ধ হলো ১ লাখ ৩১ হাজার কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

সঙ্গীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক নিয়োগ বাতিল বন্ধ হলো ১ লাখ ৩১ হাজার কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

প্রাথমিক থেকে বাদ সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক

শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলবাদি প্রভাব প্রাথমিক থেকে বাদ সংগীত ও শরীরচর্চা শিক্ষক