বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের শিক্ষকের সংখ্যা গত ১৩ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যদিও এই সময়ে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা উভয়ই বেড়েছে।
২০১১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশের জুনিয়র সেকেন্ডারি, সেকেন্ডারি এবং সেকেন্ডারি স্কুল ও কলেজের স্কুল সেকশনে ইংরেজি শিক্ষকের সংখ্যা কমেছে ১৪ হাজার ৬৭৩ জন এবং গণিত শিক্ষকের সংখ্যা কমেছে ১ হাজার ৬০৭ জন।
অন্যদিকে একই সময়ে এসব প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে ১৯,০৭০ থেকে ২০,৬৩১-এ, আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৭৫,১০,২১৮ থেকে ৮৯,৭৯,০০৯-এ।
বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য: শিক্ষকের ঘাটতিই মূল কারণ
শিক্ষাবিদরা বলেছেন, গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের ঘাটতি শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় দুর্বল ফলাফলের অন্যতম প্রধান কারণ। তারা মনে করেন, শিক্ষাক্ষেত্রে অবহেলা, শিক্ষক নিয়োগে জটিলতা এবং নিম্ন বেতন ও সুবিধার অভাবের কারণে যোগ্য প্রার্থীরা শিক্ষকতা পেশা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইইআর)-এর শিক্ষক অধ্যাপক মো. ফজলুর রহমান বলেন,
“বাংলাদেশে শিক্ষাখাত সবচেয়ে অবহেলিত খাত। এমনকি এই অন্তর্বর্তী সরকারেও এখনো কোনো শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, শিক্ষক নিয়োগে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে বহু পদ শূন্য থেকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক ফজলুর রহমানের মতে, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে স্নাতক শিক্ষার্থীরা স্কুলে শিক্ষকতা করতে আগ্রহী নন, কারণ বেতন ও সুযোগ-সুবিধা খুবই কম। এরা তুলনামূলকভাবে উচ্চ বেতনের অন্য চাকরিতে চলে যান। ফলে অন্য বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরাই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন, যাদের অনেকেরই নিয়মিত প্রশিক্ষণ বা বিষয়ের ওপর বিশেষায়িত জ্ঞান নেই।
পরিসংখ্যান: শিক্ষকের সংখ্যা কমেছে, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)-এর বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০২৪ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ২০,৬৩১টি মাধ্যমিক ও জুনিয়র মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন ৫৯,৭৯১ জন, অর্থাৎ প্রতি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ২.৯০ জন শিক্ষক। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৪,৪৬৪ জন, অর্থাৎ প্রতি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৩.৯ জন শিক্ষক।
গণিত বিষয়ে ২০২৪ সালে ২০,৬৩১ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ছিলেন ৬১,৭০৭ জন, গড়ে ৩.১৪ জন করে। ২০১১ সালে এই সংখ্যা ছিল ৬৩,৩১৪ জন, অর্থাৎ প্রতি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ৩.৩ জন।
ইংরেজি ও গণিতে দুর্বল ফল
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইংরেজি ও গণিতে দুর্বলতা শুধু পরীক্ষার ফলাফলকেই প্রভাবিত করছে না, বরং শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্রের যোগ্যতা ও দক্ষতাও হ্রাস করছে। শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অধিকাংশ অকৃতকার্য শিক্ষার্থীই ইংরেজি ও গণিতে ফেল করেছে।
বাংলাদেশে প্রাথমিকের আগে থেকেই ইংরেজি বাধ্যতামূলক বিষয় এবং গণিত দশম শ্রেণি পর্যন্ত আবশ্যিক বিষয়।
ফলাফল: ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার
২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সম্মিলিত পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ, যা ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০০৯ সালে এই হার ছিল ৬৭.৪১ শতাংশ। এবারও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে গণিতে।
২০২৫ সালের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় সব বোর্ড মিলিয়ে পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৮৩ শতাংশে, অর্থাৎ প্রায় ২০ শতাংশ পয়েন্ট কমেছে।
নয়টি সাধারণ বোর্ডে পাসের হার ছিল ৫৭.১২ শতাংশ, যা ২০০৫ সালের পর সর্বনিম্ন (২০০৫ সালে ৫৯.১৬ শতাংশ)।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে ইংরেজিতে। রাজশাহী বোর্ডে ৩২,০০০ শিক্ষার্থী এক বিষয়ে ফেল করেছে, যার মধ্যে ২২,০০০ জন ফেল করেছে ইংরেজিতে।
বাংলাদেশ ইন্টার-এডুকেশন বোর্ড কো-অর্ডিনেশন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার এহসানুল কবীর বলেন,
“প্রতি বছর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সর্বাধিক শিক্ষার্থী ফেল করে ইংরেজিতে। অনেক শিক্ষার্থী বাংলা ভাষাতেও দুর্বল, আর ইংরেজিকে তারা ভীতিকর বিদেশি ভাষা হিসেবে দেখে।”
শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগ
২০২৪ সালের ব্যানবেইস পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট ইংরেজি শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৬.৯৯ শতাংশ (১০,১৫৩ জন) ইংরেজি বিষয়ে মূল বিষয় হিসেবে পড়েছেন।
এর মধ্যে ৭.৩২ শতাংশ (৪,৩৭৪ জন) বিএ (অনার্স) ইন ইংলিশ ডিগ্রিধারী এবং ৯.৬৭ শতাংশ (৫,৭৭৯ জন) মাস্টার্স ইন ইংলিশ ডিগ্রিধারী। ২০১১ সালে এই অনুপাত ছিল মাত্র ৮.৬৭ শতাংশ (৬,৪৫৯ জন)।
গণিতের ক্ষেত্রে ২০২৪ সালে মোট গণিত শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ১৪.৬৬ শতাংশ (৯,০৪৬ জন) গণিতকে মূল বিষয় হিসেবে পড়েছেন এর মধ্যে ৭.০৮ শতাংশ (৪,৩৭০ জন) বিএসসি (অনার্স) ইন ম্যাথমেটিকস এবং ৭.৫৮ শতাংশ (৪,৬৭৬ জন) মাস্টার্স ইন ম্যাথমেটিকস। ২০১১ সালে এ হার ছিল ৮.৭৫ শতাংশ (৯,০৪৬ জন)।
অধ্যাপক ফজলুর রহমান বলেন, ২০২০ সালের কোভিড মহামারি এবং ২০২৪ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা (uprising) শিক্ষকদের ও শিক্ষার্থীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এ ছাড়া ২০২৪ সালের মাঝামাঝি ২০২১ সালের নতুন কারিকুলাম বাতিল করে পুরনো ২০১২ সালের কারিকুলাম চালু করাও শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেছে।
তিনি বলেন,
“শিক্ষকদের বেতন কাঠামো বাড়ানো উচিত, নইলে এই সংকট আরও বাড়বে।”