রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় সংরক্ষিত জলাধার ভরাট করে রামপুরা থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ড্যাপ (বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা) ২০২২–২০৩৫ অনুযায়ী জলাধারটি সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত হলেও প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র কিংবা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমোদন নেওয়া হয়নি।
গণপূর্ত অধিদপ্তর ঝিলের প্রায় ৫০ শতাংশ জায়গা রামপুরা থানার ভবন নির্মাণের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। এলাকাবাসী ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত শুধু আইনবিরোধী নয়, বরং নগর পরিবেশ ও জলপ্রবাহের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ঝিল ভরাট হলে রামপুরা–মালিবাগ–খিলগাঁও এলাকায় জলাবদ্ধতা আরও তীব্র হবে এবং স্থানীয় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
রাজউকের একাধিক সূত্র জানায়, চৌধুরীপাড়ার ঝিলটি ড্যাপ অনুযায়ী সংরক্ষিত জলাধার, যা ভরাটের কোনো সুযোগ নেই। রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম বলেন, “গণপূর্ত অধিদপ্তর রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই জলাধার বরাদ্দ দিয়েছে যা ড্যাপ ও জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০–এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা বিষয়টি তদন্তে চিঠি দেব।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “হাইকোর্টের রায়ে সংরক্ষিত জলাশয় ভরাট অপরাধ হিসেবে গণ্য। তাই শুধু দখলকারীরা নয়, অনুমোদনদাতারাও আইনের আওতায় আসা উচিত। প্রশ্ন হলো কোন সাহসে সরকারি কর্মকর্তারা এমন সিদ্ধান্ত নেন?”
সরেজমিন দেখা গেছে, চৌধুরীপাড়ার মাটির মসজিদ ও রামপুরা বউবাজারের মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় ৩৯ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত ঝিলটি এখন আংশিকভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে। গণপূর্তের ঠিকাদার সিএসআই কনস্ট্রাকশন জানিয়েছে, “এখানে রামপুরা থানার ভবন নির্মাণ হবে, আমরা নকশার অপেক্ষায় আছি।”
পরিবেশ সংগঠন ‘সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ’-এর প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার বলেন, “চৌধুরীপাড়া ঝিল ঢাকা শহরের বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন, ভূগর্ভস্থ পানির পুনর্ভরাট ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই জলাধার দখল শুধু পরিবেশ ধ্বংস নয়, এটি নগরবাসীর জীবনের ওপরও হুমকি। সরকারের দায়িত্ব হলো জলাধার সংরক্ষণ, দখল নয়।”
তিনি আরও বলেন, “কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠে থানার জন্য জমি বরাদ্দের সিদ্ধান্ত জনগণের আন্দোলনের মুখে প্রত্যাহার হয়েছিল। অথচ এখন আবার সংরক্ষিত জলাধারে ভবন নির্মাণের চেষ্টা টেকসই উন্নয়নের পরিপন্থী।”
গণপূর্ত অধিদপ্তর দাবি করছে, ঢাকার একাধিক থানার স্থায়ী ভবন নির্মাণের অংশ হিসেবে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত জলাধারের জমি সরকারি ভবনের জন্য বরাদ্দ হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জলাধার ভরাটের এই ধারা বন্ধ না হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।
চৌধুরীপাড়ার এই জলাধার দখলের ঘটনা নগর পরিকল্পনা, প্রশাসনিক জবাবদিহি এবং আইনের শাসন সব ক্ষেত্রেই নতুন প্রশ্ন তৈরি করেছে। এখন দেখার বিষয়, পরিবেশ আইন ও আদালতের রায় অমান্য করে শুরু হওয়া এই প্রকল্প সরকার কতদূর এগিয়ে নেয়, নাকি জনচাপ ও আইনি বাধার মুখে থেমে যায়।