রাজশাহী মহানগরীতে সবুজের আচ্ছাদন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে, গত পাঁচ বছরে নগরীর সবুজ গাছের সংখ্যা ২৬ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি জলাশয় কমেছে ৩ শতাংশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যৌথভাবে পরিচালিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৯০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে শীতকালীন গড় তাপমাত্রা ২.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। কিছু এলাকায় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রিরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকরা বলছেন, নগরীতে সবুজায়ন ও জলাশয়ের ক্ষতি উষ্ণায়নের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এমন প্রেক্ষাপটে বর্তমানে রাজশাহীতে চলমান তিনটি বড় উন্নয়ন প্রকল্পে মোট ২ হাজার ৬৩১টি গাছ কাটা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটার পরিকল্পনা রয়েছে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে। এছাড়া রাজশাহী ওয়াসার পানি শোধনাগার প্রকল্প এবং রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্প্রসারণের কাজের জন্যও গাছ কাটার প্রক্রিয়া চলছে।
তিন প্রকল্পে গাছ কাটার চিত্র
রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০৫ একর জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণে ১ হাজার ৮৫৩টি গাছ কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজারটি আমগাছ ও ৬৮৯টি মেহগনি গাছ রয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে একই এলাকায় টেন্ডার ছাড়াই এক ঠিকাদার কর্তৃক এক হাজারেরও বেশি গাছ অবৈধভাবে কেটে ফেলার অভিযোগ এখনও তদন্তাধীন।
অন্যদিকে রাজশাহী ওয়াসার ভূ-পৃষ্ঠস্থ পানি শোধনাগার প্রকল্পে ৭২৬টি গাছ কাটা হচ্ছে। এই গাছগুলো মূলত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের প্রায় ৩০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে কেটে ফেলা হচ্ছে। পদ্মা নদী থেকে মহানগরে পানি আনার ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকার প্রকল্পের অংশ হিসেবে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য এসব গাছ কাটা হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের জমিতে থাকা অন্তত ৩০৬টি গাছ নিলামে তোলা হয়েছে এবং বন বিভাগের অধীনে আরও ৩০৮টি গাছ কাটা হবে।
এছাড়া রাজশাহী সার্কিট হাউস সম্প্রসারণের জন্য ৫২টি গাছ কাটার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর জায়গায় ছয়তলা ভবন, চারতলা ব্যারাক ও একটি রান্নাঘর ব্লক নির্মাণ করা হবে।
কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশকর্মীদের অবস্থান
রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী বৃক্ষরোপণবিদ মীর মুকুট মো. আবু সাঈদ জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণের জন্য বাজেট না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে গাছ কাটা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ জাওয়াদুল হক বলেন, “অংশীদারদের সঙ্গে পরামর্শ করেই গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি কাটা গাছের বিপরীতে আমরা একাধিক গাছ লাগাবো। ক্যাম্পাসের ৪৯ শতাংশ এলাকা সবুজ রাখা হবে।”
তবে পরিবেশবাদীরা এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। পরিবেশকর্মী শহীদুল ইসলাম বলেন, “রাজশাহী ইতিমধ্যে চরম আবহাওয়ার শহরে পরিণত হয়েছে। এখানে নির্বিচারে গাছ কাটা বন্ধ না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় আরও তীব্র হবে।” তিনি জানান, এ বিষয়ে পরিবেশকর্মীরা বিভাগীয় কমিশনারের কাছে স্মারকলিপি দেবেন এবং প্রয়োজনে হাইকোর্টে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব নাজমুল হোসেন রাজু বলেন, “উন্নয়নের নামে কর্তৃপক্ষ যদি পুরনো গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলে, তবে আমরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবো।”
গবেষকদের মতে, নগরীর সবুজায়ন রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হলে রাজশাহীতে আগামী বছরগুলোতে আরও ভয়াবহ তাপপ্রবাহ ও পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।