সর্বশেষ

সম্পর্কিত

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তঃ যে দিন বদলে গিয়েছিল আমাদের জ্বালানি খাতের ভাগ্য

প্রকাশিত: ৯ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৫৩
সদ্য স্বাধীন দেশে আমাদের সমস্যাগুলো ছিল বহুমাত্রিক। দেশ পুনর্গঠনে দিন-রাত জাতির পিতা পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন তখন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবকিছুরই অভাব। ৯ মাসের যুদ্ধে আমাদের সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করে গেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। রিজার্ভে ছিল না কোনো টাকা। বাংলাদেশকে একেবারেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল জাতির পিতাকে। সেই সাথে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। যে বৃহৎ শক্তিগুলো আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, তারাই আন্তর্জাতিক ফুড পলিটিক্স থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আখ্যা দিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তঃ যে দিন বদলে গিয়েছিল আমাদের জ্বালানি খাতের ভাগ্য

বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে রয়েছে বিগত ৫০ বছর ধরে।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বিদেশি তেল কোম্পানি শেল ইন্টারন্যাশনাল থেকে ৫টি গ্যাসক্ষেত্র (তিতাস, হবিগঞ্জ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদ) ক্রয় করে গ্যাসক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৫ সালের ১৪ মার্চ The ESSO Undertakings Acquisition Ordinance, 1975 এর মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ESSO Eastern Inc.-কে সরকারিভাবে গ্রহণ করে জ্বালানি তেলের মজুদ, সরবরাহ ও বিতরণে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জাতির পিতার এ অবিস্মরণীয় ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ফলে দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার গোড়াপত্তন ঘটে। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের পরেও বর্তমানে দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশের বেশি জ্বালানি নামমাত্র মূল্যে কেনা এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকেই পাওয়া যাচ্ছে।

 

বঙ্গবন্ধু এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি সুরাহা করে দেন। বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য এক গেম চেঞ্জার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতির পিতা বুঝেছিলেন— ভবিষ্যতে আমাদের দেশে শিল্পায়ন বা উন্নয়ন করতে গেলে প্রথমে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অর্থাৎ, জ্বালানি ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কথাটি তিনি মাথায় রেখেছিলেন। তিনি আরেকটি বিষয় মাথায় রেখেছিলেন— জ্বালানির জন্য বিদেশ নির্ভরতা কমানো। নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে তিনি সব সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

 

ভাবলে অবাক হতে হয়, এত বিশাল গ্যাসসমৃদ্ধ ৫টি কূপ নামমাত্র মূল্যে কিনে নেওয়ার যে চুক্তিটি জাতির পিতা করেছিলেন— তখনকার সময় তো বটেই, বর্তমান বিশ্বেও জ্বালানি চুক্তিগুলোতে এমনটা ভাবা যায় না। জাতির পিতার এই সুদূরপ্রসারী চিন্তার কথা ভাবলে আমাদের মনে একটি কথাই আসে— সেসময় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও কম সাহসের বিষয় ছিল না।

 

সদ্য স্বাধীন দেশে আমাদের সমস্যাগুলো ছিল বহুমাত্রিক। দেশ পুনর্গঠনে দিন-রাত জাতির পিতা পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন তখন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সবকিছুরই অভাব। ৯ মাসের যুদ্ধে আমাদের সমস্ত অবকাঠামো ধ্বংস করে গেছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। রিজার্ভে ছিল না কোনো টাকা। বাংলাদেশকে একেবারেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়েছিল জাতির পিতাকে। সেই সাথে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। যে বৃহৎ শক্তিগুলো আমাদের স্বাধীনতা চায়নি, তারাই আন্তর্জাতিক ফুড পলিটিক্স থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং 'তলাবিহীন ঝুড়ি' আখ্যা দিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে।

 

এত কিছুর পরেও আমরা দেখতে পাই— সারা জীবন বঙ্গবন্ধু যে রাজনৈতিক দর্শন লালন করেছেন, তা হলো একটি আত্মমর্যাদাশীল স্বনির্ভর জাতি হিসেবে বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করা। একটি দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো সাশ্রয়ী ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ।

 

নিজস্ব খনিজ সম্পদ উত্তোলনের উপর বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই জোর দিয়েছিলেন। এ কারণে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠা করে দেশের খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন, পরিশোধন ও বাজারজাতকরণের সূচনা করেন।
জাতির পিতা দেশ স্বাধীন করার পর মাত্র সাড়ে ৩ বছর সময় পেয়েছিলেন দেশ গড়ার। এই সময়ের মধ্যেই তিনি বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে ভিত দরকার, তার সবই করে গেছেন। এত স্বল্প সময়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের জন্য এত কিছু করে গেছেন যে, এখন এই সময়ে এসেও আমরা তার সুফল দেখতে পাই।

 

বঙ্গবন্ধু সংবিধানের ১৪৩ নং অনুচ্ছেদে জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ সমুন্নত রেখে রাষ্ট্রের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশীয় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধু তার স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই বেশ কিছু আইনও পাশ করে গেছেন। ১৯৭৪ সালে পেট্রোলিয়াম আইন ও সমুদ্র আইন পাশ করেন। বঙ্গবন্ধু সমুদ্রে বিশাল এক সম্ভাবনা দেখেছিলেন।

 

জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা পিতার সেই স্বপ্নের পথেই হেঁটেছেন। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই তাঁরই কন্যা প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র অর্থনীতি বা ব্লু ইকোনমির রূপরেখা আমাদের দিয়েছেন। আমাদের বিশাল সমুদ্রসীমায় রয়েছে তেল-গ্যাসের বিশাল এক সম্ভাবনা।

 

জাতির পিতার পাশ করা সমুদ্র আইন দিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনি লড়াই করে বিশাল সমুদ্রসীমা জয় করেছিলেন। আমাদের সমুদ্রের বুকে তেল-গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনাকে আরও বাস্তব করতে ২০২৪ সালের ৮ মে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো অফশোর বিডিং রাউন্ড ঘোষণা করে। সমুদ্রসীমাকে মোট ২৪টি ব্লকে ভাগ করে তার সম্পূর্ণ নতুন পিএসসি বা প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট করা হয়েছিল। পরামর্শকের মতামত এবং পেট্রোবাংলার নিজস্ব পর্যালোচনার উপর ভিত্তি করে Bangladesh Offshore Model PSC 2023 প্রণয়ন করা হয়, যা ২৬ জুলাই ২০২৩ তারিখ অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়।

 

সেই পিএসসিতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল:
 

• নতুন পিএসসিতে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিসমূহকে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো গভীর ও অগভীর সমুদ্রাঞ্চলের উভয়ের জন্য বাৎসরিক Cost Recovery সর্বোচ্চ ৭৫% করা। এর ফলে কন্ট্রাক্টর তার বিনিয়োগকৃত অর্থ দ্রুত ফেরত পাওয়ায় উৎসাহিত হবে এবং Cost Recovery দ্রুত শেষ হলে পেট্রোবাংলা তথা সরকারও দ্রুত অধিক হারে লভ্যাংশ প্রাপ্ত হবে।
 

• Profit Sharing-এর ক্ষেত্রে পিএসসিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা হয়েছে। পূর্বে পিএসসিতে Profit Sharing-এর পদ্ধতি production based ছিল, যা বর্তমান পিএসসিতে Profitability Based (R-Factor) অনুসরণে করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে কন্ট্রাক্টরের বিনিয়োগকৃত অর্থ যৌক্তিক সময়ে ফেরত প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে এবং লভ্যাংশ শেয়ারের Upper Limit ও Lower Limit বিডেবল রাখার কারণে সরকারের আরও বেশি লভ্যাংশ প্রাপ্তির সুযোগ রাখা হয়েছে।
 

• গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্বে ব্যবহৃত মার্কার প্রাইস HSFO-এর পরিবর্তে অগভীর এবং গভীর সমুদ্রাঞ্চলের গ্যাসের মূল্য নির্ধারণের জন্য মার্কার প্রাইস হিসেবে Brent ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে Brent-এর ১০%। পূর্বের ন্যায় ফ্লোর এবং সিলিং না থাকায় গ্যাসের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সংযুক্ত হয়েছে।

 

আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পিএসসি প্রণয়ন করায় গত বছরের অফশোর বিডিং রাউন্ডের জন্য বিশ্বের অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান আগ্রহী ছিল। কিন্তু আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য যে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ও একদল জঙ্গির দ্বারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল হয়ে যাওয়ায় সেই বিডিং রাউন্ডে কোনো বিদেশি কোম্পানি আর আগ্রহী হয়নি।

 

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা এবং জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাসের উপর সাম্রাজ্যবাদীদের শকুনদৃষ্টি দীর্ঘদিনের। জাতির পিতার কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার উপর বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানির অনেক চাপ ছিল আনসলিসিটেডভাবে ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার। তিনি দেশের স্বার্থ বিকিয়ে সেগুলো করেননি। এখন বাংলাদেশের জনগণের ঈমানি দায়িত্ব বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা সরকার যেন আমাদের জাতীয় সম্পদ তেল-গ্যাসক্ষেত্রগুলো বিদেশীদের হাতে তুলে না দেয়।

সব খবর