ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছর পূর্ণ করলেও পরিবর্তনের আশাবাদ এখন ধীরে ধীরে হতাশায় রূপ নিচ্ছে। প্রশাসনিক অদক্ষতা, সংস্কারে বিলম্ব, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সরকার ক্রমশ সমালোচনার মুখে পড়ছে।
ক্ষমতায় আসার পর ইউনূস সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা ও পুলিশ সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন গঠন করে। কিন্তু অধিকাংশ প্রস্তাবই আজও বাস্তবায়িত হয়নি। প্রায় পাঁচ ডজন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং নীতি নির্ধারণে শীর্ষ পর্যায়ের অনিশ্চয়তা সংস্কারের গতি শ্লথ করে দিয়েছে।
আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, দেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা বেড়েছে, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ওপর রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে, এবং ইসলামপন্থী উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো গ্রাম ও শহরতলি এলাকায় প্রভাব বাড়াচ্ছে। রাজনৈতিক শূন্যতাকে কাজে লাগিয়ে এসব গোষ্ঠী নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে চরমপন্থা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করছে।
অর্থনীতিতেও সংকট গভীর হচ্ছে। ২০২৩ সালে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.৮ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা নেমে এসেছে ৪.২ শতাংশে। মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব ও দুর্নীতি থেকে মুক্তি মেলেনি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, বিক্রি কমে গেছে, ক্রেতারা খরচে সতর্ক হয়ে উঠেছেন— যা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার প্রতিফলন।
মানবাধিকার পরিস্থিতিও উদ্বেগজনক। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে হয়রানি, নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক অস্থিরতা কবলিত এলাকাগুলোতে। সাংবাদিকরা সেন্সরশিপ, হুমকি ও নির্বিচার গ্রেপ্তারের শিকার হচ্ছেন— যার ফলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রের সুরক্ষা প্রায় নেই বললেই চলে। হামলার শিকার হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, এবং অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক ও কর্মীদের লক্ষ্য করে ব্যাপক রাজনৈতিক দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে— এতে অনেকেই চাকরি, সামাজিক সহায়তা ও আইনি সুরক্ষা হারাচ্ছেন, যা সামাজিক বিভাজন আরও গভীর করছে।
সংস্কার কার্যক্রম ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে যে তারা কি আদৌ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরি করতে পারবে? নাগরিক সমাজের নেতাদের আশঙ্কা, জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ক্রমাগত সংকোচন ও উগ্রপন্থার উত্থানের ফলে, ভোট অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই গণতান্ত্রিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিতে পারে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অভিযোগ করছে যে, ইউনূস সরকার সুস্পষ্ট কৌশল ছাড়াই চলছে। তাদের মতে, সরকার নাগরিকদের অধিকার রক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করে নিজেদের কর্তৃত্ব শক্তিশালী করতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বপ্ন ক্রমেই ম্লান হচ্ছে। বরং তারা এখন আশঙ্কা করছেন— এই অন্তর্বর্তী নেতৃত্বের ব্যর্থতা দেশকে আরও গভীর অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে।
সূত্রঃ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস