সর্বশেষ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে সংকটঃ ৮২ ব্যাচের প্রাধান্য, অবসরপ্রাপ্তদের পুনঃনিয়োগ এবং ওএসডি সংস্কৃতির প্রভাব

প্রকাশিত: ১৯ অগাস্ট ২০২৫, ১৬:৪১
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনে সংকটঃ ৮২ ব্যাচের প্রাধান্য, অবসরপ্রাপ্তদের পুনঃনিয়োগ এবং ওএসডি সংস্কৃতির প্রভাব

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনে নতুন সংস্কারের ঘোষণা থাকলেও মাঠ পর্যায়ে বাস্তবতা বিতর্ক ও অনাস্থার সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পুনঃনিয়োগ, বিপুলসংখ্যক ওএসডি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের অকার্যকরিতা ও অনিয়ম প্রশাসনিক কার্যকারিতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

 

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা বর্তমান প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবশালী পদে অবস্থান করছেন। ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে অবসরে থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্যতার কারণে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের প্রাধান্য মন্ত্রিপরিষদ, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বিস্তৃত।

 

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনঃনিয়োগ একটি বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অন্তত পাঁচজন অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কর্মকর্তা পুনঃনিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ড. শেখ আব্দুর রশীদ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর অব্যবহিত পরই পদোন্নতি পেয়ে আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদ মন্ত্রীপরিষদ সচিবও হন। মোহাম্মদ আবদুল মোমেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব হিসেবে নিয়োগের পর দুদকের চেয়ারম্যান হন। এছাড়া মো. নাসিমুল গনি, মো. মোখলেস উর রহমান ও মো. এহছানুল হক—তিনজনই ৮২ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা—সিনিয়র সচিব হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

চলতি বছরের ২৬ জুন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিতর্কিত পরিপত্রে ‘নতুন বাংলাদেশ দিবস’ ঘোষণা করা হলেও দেশের বিভিন্ন মহল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার মুখে এ সিদ্ধান্ত স্থগিত করতে হয়। এ বিষয়ে মন্ত্রীপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ জানান, “সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী আমরা রাষ্ট্রকে ভালোভাবে পরিচালনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা সিনিয়র পজিশনে আছেন, কিন্তু এখানে নিয়ন্ত্রণের কোনো একক ক্ষমতা নেই।”

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি, খুন, ডাকাতি, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং অপহরণের মতো ঘটনার পরিসংখ্যান সরকারের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গোপালগঞ্জে সহিংসতার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠনের পরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যকারিতা নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে। স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি ১৯৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা যিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে দায়িত্ব পালন করছেন।

 

অন্যদিকে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও ধীরগতি ও অকার্যকারিতায় সমালোচনার মুখে। ফ্রেব্রুয়ারিতে সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচী ঘোষণার পরও মাঠ প্রশাসন সাজানো সম্ভব হয়নি। ডিসিদের নিয়োগ চূড়ান্ত না হওয়া, পদোন্নতিপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিবদের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নতুন নিয়োগ স্থগিত থাকা সরকারের প্রস্তুতি প্রক্রিয়ায় বড় বাধা সৃষ্টি করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের নেতৃত্বে কার্যক্রম শিথিল হওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

 

প্রতিবন্ধকতার আরও একটি চিত্র হলো ওএসডির সংখ্যা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে ৫১৭ জন কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। এর মধ্যে ১২১ জন প্রশাসন ক্যাডারের, ৩৩ জন যুগ্ম সচিব, ৭৬ জন উপ-সচিব, ১৩৬ জন সিনিয়র সহকারী সচিব, ১৫৫ জন সহকারী সচিব, ৮ জন সিনিয়র সহকারী প্রধান এবং ১৩ জন সিনিয়র সচিব বা সচিব। পুলিশ বিভাগেও ৮২ সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। এই বিশাল সংখ্যা প্রশাসনের কার্যকারিতা কমাচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পুনঃনিয়োগ এবং ওএসডি সংস্কৃতি নতুন নেতৃত্ব তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছে। প্রশাসনের মূল কাঠামোয় পুরোনো প্রভাব বজায় থাকায় নতুন নীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিকূলতা দেখা দিচ্ছে। রাজশাহীর মিনারুল ইসলামের সপরিবার আত্মহত্যা, নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি, বন্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, শিল্প-উৎপাদন ও বিনিয়োগের স্থবিরতা— এসব পদক্ষেপ সরকারের ব্যাহত নীতিরই সাক্ষর বহন করছে।

 

নাগরিক সমাজের নেতারা মন্তব্য করছেন, “দুর্নীতি ও প্রশাসনিক কার্যক্রমের ব্যর্থতা শুধুমাত্র ৮২ ব্যাচের বিষয় নয়; পুরো জনপ্রশাসনের পুনঃমূল্যায়ন জরুরি। সরকারের প্রদত্ত ‘সংস্কার’ সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি। জনমুখী প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য অংশীজনদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন।”

 

সাবেক সচিব ও বিশ্লেষকরা বলছেন, “অবসরপ্রাপ্ত ও সুযোগসন্ধানী কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়ন, অন্তর্বর্তী সরকারের অস্পষ্ট নির্দেশনা এবং প্রশাসনিক সংস্কারের অভাব একসঙ্গে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে দুর্বল করছে। এর ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের তথাকথিত ‘নতুন বাংলাদেশ’ এখন পর্যন্ত একটি ব্যর্থ ধারণা হয়ে আছে।”

 

নাগরিক সমাজ ও সাধারণ জনগণ প্রশাসনিক সংস্কারের বাস্তব ফলাফল দেখার অপেক্ষায়। স্বচ্ছ, দক্ষ ও জনমুখী প্রশাসনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত ‘সংস্কার’ এবং ‘নতুন বাংলাদেশ’ নির্মাণ ফাঁকা বুলি হয়ে রয়ে যাবে।

সব খবর