বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর এসে বাঙালি তখন স্বাধীনতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। দেশের মুক্তাঞ্চল ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে, দখলমুক্ত এলাকায় উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার অগ্রযাত্রায় পাকিস্তানি দখলদারদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত ভেঙে পড়ছে। যুদ্ধের বাস্তবতা বদলে যেতে থাকায় বিশ্বরাজনীতির মাঠেও পাকিস্তান দিন দিন বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে।
পাকিস্তানের পরাজয় স্পষ্ট, শুরু কূটনৈতিক লড়াই
ডিসেম্বরের শুরুতেই সম্মুখযুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। তার ওপর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শানিত আক্রমণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বিপর্যস্ত। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বুঝে যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
পরাজয় ঠেকাতে পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। একাত্তরের এই দিনে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি এবং ভারত-পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব তোলে। কিন্তু বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভেটো প্রদান করলে পাকিস্তানের শেষ কূটনৈতিক আশাটুকুও ভেস্তে যায়। ভৌগোলিক যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক যুদ্ধে পাকিস্তানের অবস্থান তখন পুরোপুরি দুর্বল।
ঢাকার আকাশ দখলে মিত্রবাহিনী, পাকিস্তানি বিমানবাহিনী কার্যত নিঃশেষ
৫ ডিসেম্বর ঢাকার আকাশ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয় ভারতীয় মিত্রবাহিনীর বিমানবাহিনী। পাকিস্তানের জঙ্গি বিমানগুলো তখন প্রায় সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত বা অকার্যকর। ভোর থেকে বেলা পর্যন্ত ঢাকার আকাশে চলে তুমুল ডগফাইট, যা মানুষ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ করে। আকাশে মিত্রবাহিনীর অবাধ বিচরণ পাকিস্তানি বাহিনীকে আরও কোণঠাসা করে তোলে।
সিলেট সেক্টরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণে শত্রুর পাঁচটি বাংকারসহ ডজনখানেক যানবাহন ধ্বংস হয়। তেজগাঁও বিমানবন্দর ও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতেও মিত্রবাহিনী আঘাত হানে।
একাধিক সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি, একের পর এক অঞ্চল শত্রুমুক্ত
এই দিনে যুদ্ধে গতি আসে তীব্রতা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে কুমিল্লা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহসহ ঢাকার চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করতে থাকে। যশোর সেক্টরে কোটচাঁদপুর দখলের পর মুক্তিবাহিনী ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হয়।
পশুর নদীর মোহনায় পাকিস্তানি নাবিকদের ‘আনোয়ার বক্স’ জাহাজে পালানোর চেষ্টাও ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যর্থ করে দেয়। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর, দর্শনা, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরসহ বহু এলাকা শত্রুমুক্ত হয়।
মেজর জলিলের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী সাতক্ষীরা মুক্ত করার পর খুলনার দিকে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডারের নেতৃত্বে সিংহঝুলি ও ঝিকরগাছা মুক্ত হয়। যৌথ বাহিনী তিন দিক থেকে যশোর আক্রমণ করে রেলওয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, ফলে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটার পথ হারায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি সৈন্যদের পেছনে সরে আসার নির্দেশ দিলেও তা আর সম্ভব হয়নি, কারণ যশোর-ঢাকা সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ রুটগুলো ইতোমধ্যেই মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
জাতিসংঘে উত্তপ্ত আলোচনা, বন্ধুহীন পাকিস্তান
একাত্তরের এই দিনে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে একাধিক প্রস্তাব ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির নামে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালালেও সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে বেলজিয়াম-ইতালি-জাপানের আরেকটি প্রস্তাবও আলোচনায় আসে, কিন্তু সৈন্য প্রত্যাহারের প্রশ্নে মতভেদ তৈরি হয়।
সোভিয়েত প্রতিনিধি জ্যাকব মালিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে পাকিস্তানপন্থী ও একপেশে বলে আখ্যা দেন। অন্যদিকে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেন যুক্তি দেন—বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে আলোচনায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিলে কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবসম্মত হবে না।
শেষ সময়ের যুদ্ধ, পাকিস্তানের পতনের কাউন্টডাউন
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের পরাজয়—সব মিলিয়ে ৫ ডিসেম্বরের দিনটি ছিল স্বাধীনতার কাউন্টডাউন শুরু হওয়ার দিন। সম্মুখযুদ্ধ, কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং অভ্যন্তরীণ ভাঙনের এক দ্বিগুণ সংকটে পড়ে পাকিস্তান আত্মসমর্পণের দিকে ধাবিত হতে থাকে। আর বীর বাঙালি এগিয়ে যেতে থাকে বিজয়ের দিকে।