সর্বশেষ

তিতাসপাড়ের সুর আজ নিঃশব্দ

আলাউদ্দিন খাঁর পুণ্যভূমিতে এ কোন অন্ধকার

ফিচার ডেস্ক বিডি ভয়েস
প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ২৩:২২
আলাউদ্দিন খাঁর পুণ্যভূমিতে এ কোন অন্ধকার

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন জেলরোডে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী ‘দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’ আজ অস্তিত্ব সংকটে। দুই দফা অগ্নিসংযোগের পর এবার সেটি বেদখলের ঝুঁকিতে পড়েছে। সংগীতসাধনার এক মহান ইতিহাসের ভগ্নাবশেষে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে তিতাসের তীরে যে জনপদ একদা সাধক ও শিল্পীদের পুণ্যভূমি ছিল, সেখানে আজ এই অন্ধকার কেন?

 

সাধনা থেকে সংকটের পথে

 

১৯৫৬ সালে মহান সুরসাধক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এই সংগীতাঙ্গন প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল এখানে একটি সংগীত কলেজ গড়ে তোলা। একই সময়ে কলকাতায় তাঁর পুত্র ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আলী আকবর কলেজ অব মিউজিক’, যা পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া ও সুইজারল্যান্ডেও শাখা সম্প্রসারিত করে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাঁর সেই উদ্যোগ ক্রমে উপেক্ষা, অগ্নিসংযোগ ও দখলের হুমকিতে নিঃশেষ হতে বসেছে।

 

খবরে জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে কেনা সেই বাড়িটিতেই গড়ে উঠেছিল সংগীতাঙ্গনটি। এর মধ্য দিয়ে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর লক্ষ্য ছিল গুরুমুখী সংগীতচর্চার ধারাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। অথচ আজ ৬৯ বছর পরও বাংলাদেশে সংগীত শিক্ষার এমন বিস্তৃত কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ের সংগীত কলেজ ছাড়া দেশে বিশেষায়িত সংগীত শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত অনুপস্থিত।

 

অগ্নিসংযোগ, অবহেলা ও উদাসীনতা

 

২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথমবার এবং ২০২১ সালের মার্চে দ্বিতীয়বার ‘দি আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গন’-এ অগ্নিসংযোগ করা হয়। ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থের অমূল্য ক্ষতি সাধিত হয়। তবুও রাষ্ট্রীয় বা প্রশাসনিক কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সংগীতাঙ্গন এখন নিভু নিভু অবস্থায় টিকে আছে, স্থানীয় শিল্পীদের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়।

 

রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতিধন্য কোনো জাদুঘর, সংরক্ষণাগার বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি বহুদিনের। কিন্তু বাস্তব উদ্যোগ অনুপস্থিত। দেশজুড়ে ঝলমলে অনুষ্ঠান বা আলো উৎসবের আয়োজন হলেও সংগীত ও সংস্কৃতির এই উত্তরাধিকার রক্ষায় দেখা যায় না কোনো কাঠামোগত দৃষ্টিভঙ্গি।

 

ঐতিহ্যের বিলোপ ও সামাজিক পতন

 

তিতাসপাড়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া একসময় ছিল সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র। সাধক আফতাব উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, আয়েত আলী খাঁ, সাধক মনমোহন দত্ত এই জনপদ থেকেই উঠে এসেছেন অগণিত মনীষা। অথচ আজ এই শহর সংবাদে আসে টেঁটাযুদ্ধ বা তুচ্ছ বিবাদের ঘটনায়। শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়ের ছায়ায়।

 

রাষ্ট্রের সংগীত ও শিল্পকলার বিকাশে উদাসীনতা নতুন নয়। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও সংগীত শিক্ষার পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত সরকার নিজেই নিয়ে শিল্পচর্চার বিপরীতে নতজানু অবস্থান প্রকাশ করেছে। অথচ সংগীত শিক্ষক তৈরির সক্ষমতাও আজও সীমিত—মাত্র কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত বিষয়ে স্নাতক পড়ানো হয়।

 

বিশ্বের মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতেও সরকার নিজেই শিল্প ও সংগীতচর্চার পৃষ্ঠপোষক, অথচ বাংলাদেশে উগ্রবাদী চাপে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ফলে ‘সুরের দেশ’ ব্রাহ্মণবাড়িয়া আজ যেন অন্ধকারের অতলে ডুবে যাচ্ছে।

 

বংশধরদের দ্বন্দ্ব ও আইনি জটিলতা

 

সম্প্রতি সংগীতাঙ্গনের জমি নিয়ে মালিকানা বিরোধ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর মেয়ে সরোজা বেগমের নাতি হাবিব খাঁ জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করেছেন। অপরদিকে ওস্তাদের ভাতিজা, খ্যাতিমান সুরকার শেখ সাদী খান জানান, “আলাউদ্দিন খাঁ কোনো জমি দান করেননি।”

 

ভারতে বসবাসকারী প্রপৌত্র সিরাজ আলী খান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরকে বলেন, “যারা জমির মালিকানা দাবি করছে, তাদের সঙ্গে ভারতের মাইহার, কলকাতা ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রকৃত বংশধরদের কোনো যোগাযোগ নেই।” তিনি নিজেও মাইহার ঘরানার সংগীতের ধারক ও বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী ধ্যানেশ খানের পুত্র। এই বিতর্ক তাই শুধু পারিবারিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার প্রশ্নে জাতীয় দায়িত্বের প্রতিফলন।

 

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সময় এখনই

 

দেশজ ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের দাবি আজ তীব্র। শুধু রাজধানীতে উৎসব আয়োজন নয়, বরং স্থানিক ইতিহাস ও সংগীতচর্চাকে জীবন্ত রাখাই প্রকৃত শ্রদ্ধা। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর নামে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে।

 

এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সংগীত শিক্ষার নতুন দিগন্তই নয়, বরং খাঁ পরিবারের সংগীত ঐতিহ্যের টেকসই পরম্পরাও নিশ্চিত করতে পারে। খাঁ পরিবারের সুযোগ্য উত্তরাধিকারীরা আজও বিশ্বের নানা প্রান্তে সক্রিয় তাদের সহযোগিতায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই সংগীতাঙ্গন শুধু একটি স্থাপনা নয়, এটি বাংলাদেশের সংগীত ইতিহাসের একটি প্রতীক। এই পুণ্যভূমি রক্ষা করা রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতিবান নাগরিকদের সম্মিলিত দায়িত্ব।

 

সাধক আফতাব উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, মনমোহন দত্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেন আবার হয়ে উঠুক শিল্প ও সংগীতের তীর্থভূমি এটাই এখন সময়ের দাবি। ধানের দেশ, গানের দেশ এই কথাটিকে সত্য করে তুলতেই শুরুটা হোক আলাউদ্দিন খাঁর পুণ্যভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে।

সব খবর