মুক্তিযুদ্ধের এই দিনের তাৎপর্য ইতিহাসে বিশেষভাবে উজ্জ্বল। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পথে মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বার অগ্রযাত্রা স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। একাত্তরের এই দিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হতে শুরু করে। বিজয়ের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে আকাশে-বাতাসে যা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের আরও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
ডিসেম্বরে মুক্তিবাহিনী যখন ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যৌথ আক্রমণ চালিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন শুধু রণাঙ্গনেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পাকিস্তান পায়ের তলা থেকে মাটি হারাতে থাকে। রণাঙ্গনে তীব্র যুদ্ধ চলার পাশাপাশি জাতিসংঘেও চলছিল আরেক ধরনের লড়াই- বাংলাদেশের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির মধ্যে কূটনৈতিক যুদ্ধ।
৪ ডিসেম্বর ১৯৭১, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিরাজ করছিল তীব্র উত্তেজনা। পাকিস্তানের পক্ষে মার্কিন প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ (জর্জ ডব্লিউ বুশের বাবা) নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তা থেকে বঞ্চিত করা। প্রস্তাবে দাবি করা হয়, ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশকে অবিলম্বে নিজ নিজ সীমান্তে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে।
এই সময় ভারতের আশ্রয়ে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারও ছিল গভীর উদ্বেগে। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি লিখে অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানান। পত্রে তাঁরা উল্লেখ করেন, “ভারত সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে স্বীকৃতি দান করুক। আমরা আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, এই ভয়াবহ বিপদের সময়ে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ আপনাদের সঙ্গে রয়েছে। আমাদের যৌথ প্রতিরোধের ফলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের হীন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবেই।”
নিউইয়র্কে টানা বৈঠকের পর অবশেষে গুরুত্বপূর্ণ খবর আসে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবটি পাস হয়নি। পোল্যান্ড প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়, আর ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ভোটদানে বিরত থাকে যা প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের জন্য বড় স্বস্তির বার্তা ছিল।
নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র পরে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এবং সেখানে তা পাস করাতে সক্ষম হয়। তবে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাধ্যতামূলক না হওয়ায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদের যৌথ বাহিনীর অগ্রযাত্রায় কোনো প্রভাব পড়েনি। ১১ সেক্টরজুড়ে সাঁড়াশি আক্রমণে পাক হানাদার বাহিনী তখন পালানোর পথ খুঁজছিল মরিয়া হয়ে।
সব মিলিয়ে, ৪ ডিসেম্বর ছিল মুক্তিযুদ্ধের গতি বদলে দেওয়ার দিন যেদিন রণাঙ্গন ও আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের বিজয়ের পথ আরও দৃঢ়ভাবে উন্মুক্ত হয়ে যায়।