একসময় দেশের প্রাকৃতিক মাছের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিল কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল। কিন্তু এখন সেই হাওর হারাচ্ছে তার পুরনো প্রাণ—দেশি মাছ। করিমগঞ্জ উপজেলার ধনু নদীর তীরে অবস্থিত বালিখলা মাছ বাজারে এখনও প্রতিদিন সকালে বাজার বসে, কিন্তু আর দেখা যায় না আগের সেই মাছের প্রাচুর্য ও জৌলুস। দেশি মাছের সংখ্যা কমে গেছে, কমেছে ব্যবসা, আর সংকটে পড়েছেন হাজারো জেলে।
ভোরের বাজারে আগের প্রাণ নেই
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) সকালে বালিখলা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগে যেখানে প্রতিটি কোণে মাছের স্তূপ থাকত, এখন সেখানে হাতেগোনা কিছু মাছ ঘিরেই সীমিত কেনাবেচা। ইটনা থেকে আসা জেলে মনির উদ্দিন বলেন, “রাতভর জাল ফেলেও এখন যা পাই, তা দিয়ে খরচই ওঠে না। পাবদা, চাপিলা, শিং, গজার—যেসব মাছ একসময় প্রচুর ছিল, এখন সেগুলো খুবই বিরল।”
একই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন জেলে মতিউর মিয়া। তিনি বলেন, “আগে নৌকা বোঝাই করে মাছ আনতাম, এখন নৌকার তলায় প’ড়ে থাকে মাছ। সংসার চালানোই কঠিন হয়ে গেছে। অনেক জেলে বাধ্য হয়ে পেশা বদলাচ্ছে—কেউ শহরে চলে যাচ্ছে, কেউ দিনমজুরি করছে।”
কমেছে আড়তের আয়, থমকে যাচ্ছে ব্যবসা
হাওরে পানি কমে যাওয়া ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার মারাত্মক আকার ধারণ করায় মাছের উৎপাদন দ্রুত কমছে। বালিখলা বাজারের প্রবীণ আড়তদার নিপেন্দ্র বর্মণ জানান, “এখানে আগে ৬৫টি আড়তে দিনে গড়ে ৬–৭ লাখ টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন সেটা অর্ধেকেরও কম। ছোট আড়তদাররা সবচেয়ে বেশি বিপদে।”
বাজারের সাধারণ সম্পাদক সালাহ উদ্দিন বলেন, “দু–তিন বছর আগেও দিনে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার মাছ বিক্রি হতো। এখন জেলে কম আসছে, পাইকাররাও আগ্রহ হারাচ্ছে। বাজারের প্রাণশক্তিই হারিয়ে যাচ্ছে।”
কেন কমছে দেশি মাছ
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাওরে আগের মতো বর্ষার পানি থাকে না। নদী-নালা ও জলাশয় পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় মাছের চলাচল ও প্রজননে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিষিদ্ধ জালের নির্বিচার ব্যবহার, যা মা-মাছ ও পোনাসহ সব ধ্বংস করছে। এতে প্রজনন চক্র ভেঙে পড়ছে।
এছাড়া হাওরের ধানচাষে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহার পানিকে দূষিত করছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা ও জলাশয় দখলও মাছের আবাসস্থল সংকুচিত করছে। ফলস্বরূপ, মাছের প্রজাতি যেমন কমছে, তেমনি টিকে থাকা প্রজাতিগুলোর সংখ্যাও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
বৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, সংখ্যার শঙ্কা
এক দশক আগেও কিশোরগঞ্জের হাওরে পাওয়া যেত ১৪৩ প্রজাতির দেশি মাছ। বর্তমানে টিকে আছে মাত্র ৭০–৭৫ প্রজাতি। চাপিলা, কালবাউশ, টাটকিনি, শোল, মহাশোলসহ বহু মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। রুই, কাতল, বোয়াল, টেংরা, গজার পাওয়া গেলেও আগের মতো সহজলভ্য নয়।
২০২২–২৩ অর্থবছরে কিশোরগঞ্জে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন, যার মধ্যে হাওর থেকে এসেছে ২৮ হাজার ২০ টন—মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। তবে হাওরভিত্তিক সরবরাহ প্রতিবছর কমছে, যা ভবিষ্যতে মাছের চাহিদা পূরণে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
জীবিকা ও অস্তিত্বের সংকট
জেলে হাফিজ উদ্দিন বলেন, “দাদা-বাবা মাছ ধরেই সংসার চালাতেন। এখন ছেলে শহরে কাজ খুঁজছে। এই পেশা হয়তো আর টিকবে না।”
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম জানান, “পানি কমে যাওয়া ও নিষিদ্ধ জালের কারণে মাছের প্রজনন চক্র ভেঙে পড়ছে। আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, জাল জব্দ করছি, সচেতনতা বাড়াচ্ছি। তবে শুধু প্রশাসনের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়—স্থানীয় জনগণকেও এগিয়ে আসতে হবে।”
হাওরের দেশি মাছ শুধু খাবার নয়—এটি এই অঞ্চলের সংস্কৃতি, জীবিকা ও পরিবেশের প্রাণ। এই বৈচিত্র্য রক্ষা না করলে হারিয়ে যাবে একটি প্রাকৃতিক ঐতিহ্য।