সর্বশেষ

রোকেয়া দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

বেগম রোকেয়ার শিক্ষাব্রত

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩:৫৮
৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে আমরা স্মরণ করি বাংলার নারীজাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেনকে যিনি শিক্ষার আলো দিয়ে নারীমুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কঠোর বাধা ভেদ করে তিনি নারীশিক্ষা, সাহিত্যচর্চা ও সামাজিক পুনর্জাগরণের এক উজ্জ্বল ইতিহাস গড়ে গেছেন। তাঁর জীবন, সংগ্রাম ও শিক্ষাদর্শ আজও আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
বেগম রোকেয়ার শিক্ষাব্রত

১.

বাংলা তথা উপমহাদেশের নারী বিশেষত মুসলিম নারী জাগরণের ইতিহাসে রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন এক অনন্য ও অবিস্মরণীয় নাম। বিংশ শতাব্দীর কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি মুসলিম সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, অবরোধ ও অবজ্ঞায় জর্জরিত নারী জাতিকে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ ও উদ্ভাসিত করার এক মহান ব্রতী, সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। বিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের সূচনালগ্নে নারীশিক্ষা, নারী জাগরণ, নারীর স্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতার পদক্ষেপে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। মুসলমান সমাজের অনগ্রসর যুগে নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল একক, ব্যতিক্রমী ও অনন্যসাধারণ। অনতিদীর্ঘ জীবনের সবটুকু তিনি উৎসর্গ করেছেন নারীশিক্ষা, নারীমুক্তি ও সাহিত্যসাধনায়। ঔপনিবেশিক বাংলার অবহেলিত, নির্যাতিত অবরোধ নারীদের মাঝে শিক্ষার আলোকবর্তিকা এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থার বিষবাষ্প থেকে নারীমুক্তির অগ্রদূত হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। নারী শিক্ষার প্রসার এবং সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে নারী মুক্তির মাধ্যমে নারী সমাজের জাগরণে বেগম রোকেয়া এক কালজয়ী অবদান রাখতে সক্ষম হন। সাহিত্যে চর্চা, শিক্ষা বিস্তার, মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠা, প্রচলিত সমাজ কাঠামোর উপর মাধ্যমে কৌশলগত অভিঘাত সৃষ্টি প্রভৃতি কর্মকা-ের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলার নারী সমাজের জাগরণে বেগম রোকেয়া যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তা কেবল অনন্যই নয় বিস্ময়করও বটে। বাঙালি মুসলিম নারীসমাজকে তিনি হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন নতুন আলোর পথে। 

 

২.

বেগম রোকেয়া জন্মেছিলেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে, এক জমিদার পরিবারে। আনুমানিক ১৬ বছর বয়সে বিহারের অধিবাসী বিপত্নীক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেনের সঙ্গে রোকেয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁর নাম হয় রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তবে তিনি বেগম রোকেয়া নামেই সমধিক পরিচিত। ১৯০৯ সালের ৩ মে সৈয়দ সাখাওয়াৎ হোসেন মারা যান। আর রোকেয়া মারা যান ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, মাত্র ৫৩ বছর বয়সে। লেখক হিসেবে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন, সংগঠক হিসাবে রোকেয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারীর কল্যাণে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি, বাঙালি-মুসলমান, নারীশিক্ষা, নারীজাগরণ তাঁর কর্মকা-ের মূলভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রোকেয়া দিবসে নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং আলোর দিশারি এই মহীয়সী নারীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

 

৩.

বেগম রোকেয়া ছিলেন নারী শিক্ষার এক জ্যোর্তিময় আলোকবর্তিকা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও বেগম রোকেয়া উপলব্ধি করেছিলেন যে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থায় নারী জাতির অবনতির মূল কারণই হলো শিক্ষার অভাব। আর এ উপলব্ধি থেকে তিনি নারী শিক্ষার প্রসারে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। নারীকে শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার মাধ্যমে নারী-পুরুষ সাম্যের এক সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল বেগম রোকেয়ার লক্ষ্য। স্বামীর সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান এবং নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি রোকেয়ার চিন্তা ও কাজের সহায় হয়েছিল। স্বল্পস্থায়ী সংসার জীবনে তিনি পড়াশোনা ও সামাজিক মেলামেশার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন, সমাজে নারীরা কতটা নিগৃহীত। স্বামীর সহযোগিতায় রোকেয়া পাশ্চাত্য জীবনধারা, গণতন্ত্রের গতি-প্রকৃতি ও নারী সত্তার বিকাশের নানা স্তর ও পথ নির্দেশনা পান। রোকেয়া পুরুষাধিপত্য, ধর্মান্ধতা দূর করে নারীকে উপযুক্ত স্থানে প্রতিষ্ঠা করার হিসেবে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি তাঁর যুগের কুসংস্কার আর ধর্মীয় গোঁড়ামীকে উপেক্ষা করে বাঙালি মুসলিম মেয়েদের স্কুলে শিক্ষা লাভের নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। আর এজন্য তিনি ১৯০৯ সালে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গালর্স স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বেগম রোকেয়ার মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্যে হল মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি স্ত্রী শিক্ষা সম্পর্কে বলেন, “আমরা যাহা চাহিতেছি তাহা ভিক্ষা নয়,অনুগ্রহেরদান নয়-আমাদের জন্মগত অধিকার।’

 

৪.

রোকেয়ার সময় ছিল বাংলার নারী সমাজের জন্য অন্ধকার যুগ। যার অর্থ পশ্চাৎপদ অবস্থা, ধর্মান্ধতা, পর্দা প্রথা, গোঁড়ামী, কুসংস্কার, নির্যাতন, বৈষম্য, বঞ্চনা, শোষণের বেড়াজালে নারীকে শুধুমাত্র বন্দি করেই রাখা হয়নি মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হতো। পাশবিক, ভয়াবহ ও অমানবিক সেই সময় একটা দুঃসময় ছাড়া আর কিছু নয়। ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে বলেছেন, ‘তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজেরাই নিজেদের অন্ন, বস্ত্র উপার্জন করুক।’ কত সত্য ও কঠিন কথা। সেদিন সেই দুঃসহ সময়ে তিনি এমন কথাটি দুঃসাহসের সাথে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন। কারণ নারী শিক্ষা বিস্তারই ছিল বেগম রোকেয়ার জীবনের প্রধান ব্রত। স্বামীর মৃত্যুর মাত্র পাঁচ মাস পরেই (অক্টোবর, ১৯০৯) তিনি ভাগলপুরে সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষাকে তিনি গতানুগতিক দৃষ্টিতে শুধু চাকুরি লাভের ‘উপায়’ হিসেবে দেখেননি। ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশের ‘অন্ধ অনুকরণ’ নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা দিয়েছেন, সেই ক্ষমতাকে অনুশীলন করাই শিক্ষা। ঐ গুণের সদ্ব্যবহার করা কর্তব্য এবং অপব্যহার করা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত, পদ চক্ষু, কর্ণ,মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত দ্বারা সৎকার্য করি, চক্ষু দ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষèভাবে চিন্তা করিতে শিখিÑতাহাই প্রকৃত শিক্ষা। আমরা কেবল ‘পাস করা বিদ্যা’- কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না।’

 

৫.

রোকেয়া কোনো কিছু মুখস্থ করাকে ঘৃণার চোখে দেখতেন। এমনকি মুসলমান মেয়েদের পবিত্র কোরআনের মর্মবাণী উপলব্ধি না করে মুখস্থ করাকেও তিনি সুনজরে দেখেননি। ধর্ম শিক্ষায় পবিত্র কোরআনের মর্মার্থ অনুশীলন ও অনুধাবনের ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। নীতি শিক্ষা ও চরিত্র গঠনের শিক্ষায় তিনি আচরণ অনুশীলনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি ব্যবহারিক কাজের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে, মিথ্যা ইতিহাস বা ইতিহাসের নিরেট ঘটনা পাঠ নয়; বরং ইতিহাসকে জীবনের ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করা এবং তা থেকে দেশপ্রেম শিক্ষা ও স্বাধীনতার প্রেরণা লাভ করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানকেও তেমনি ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার কথা বলেন তিনি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ বইয়ে তাঁর কল্পনার নারীকে বিজ্ঞানের জ্ঞান সম্প্রসারণে সব সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত রেখেছেন। নিজের প্রতিষ্ঠানেও বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে এ ব্যবহারিক দিকের ওপরই জোর দিয়েছেন তিনি। নারী শিক্ষাকে ফলপ্রসূ করতে প্রকৃতি ও বস্তু পাঠ এবং বৃত্তি শিক্ষাকে রোকেয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। মূলত রোকেয়ার শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রয়োগবাদী দর্শনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল নারীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার বিকাশ।

 

৬.

নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেড়িয়ে কলকাতায় আগমন তাঁর জীবনের পক্ষে ইতিবাচক হয়েছিল।  এখানেই তাঁর সুপ্ত প্রতিভা পরির্পুণভাবে বিকাশ লাভ করার সুযোগ হয়। রোকেয়ার সাহিত্যর্কমের বড়  অংশই কলকাতাতে সম্পন্ন হয়। ‘মতিচূর’ (২য় খন্ড), ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’ প্রভৃতি গ্রন্থ তিনি কলকাতায় বসে রচনা করেন। শিক্ষাকর্মের প্রায় সবটুকুই পরিচালিত হয় কলকাতায়। ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ ভাগলপুর থেকে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গালর্স স্কুল’ কলকতার ১৩নং ওয়ালিউল্লা লেনের একটি বাড়িতে স্থানান্তর করেন। কলকাতায় স্কুলটি মাত্র আটজন ছাত্রী ও দু‘খানা বেঞ্চ নিয়ে শুরু হয়। পরবর্তীকালে ছাত্রী সংখ্যা বাড়ায় এ গৃহে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১৯১৩ সালের ৯ মে স্কুলটি ১৩নং ইউরোপিয়ান এ্যাসাইলাম লেনে সারানো হয়। ১৯১৫ সালের শুরুতে স্কুলটি উচ্চ প্রাইমারি বিদ্যালয়ে পরিণত হয় এবং বছরের শেষে ছাত্রী সংখ্যা ৮৪-তে দাঁড়ায়। ছাত্রীসংখ্যা ত্রুমান্বয়ে বাড়াতে থাকায় ১৯১৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এ স্কুল ৮৬/এ লোয়ার সাকুলার রোডের ঠিকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯১৬ সালে স্কুলে ছাত্রী সংখ্যা ১০৫-এ পৌঁছায়। বিদ্যালয়ের উন্নতির জন্য তাঁকে প্রতিনিয়ত হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়েছে। শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার পরিমাণগত ও গুণগত উভয়বিধ মানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাই শুধুছাত্রীসংখ্যা বাড়ানো নয়, বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর প্রতিও রোকেয়া সমান আন্তরিক ছিলেন। এজন্য তিনি বিদ্যালয়ের নিয়ম কানুন, বিধি- ব্যবস্থা, আইন-শৃঙখলা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে সুষ্ঠুভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এসব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতার ইংরেজ,বাঙালি নির্বিশেষে সকল অভিজ্ঞ ও কর্মদক্ষ মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ ও মেলামেশ শুরু করেন। ত্রুমে তিনি কলকাতার মিসেস পি. কে. রায়, মিসেস রাজকুমারী দাস প্রমুখ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মহিলার সংস্পর্শে আসেন। বেগম রোকেয়ার এ জাতীয় নিষ্ঠা ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গালর্স স্কুল’ ১৯১৭ সালে ‘মধ্য ইংরেজি’ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ১৯৩০ সালে স্কুলটি ‘উচ্চ শিক্ষা’র মর্যাদা লাভ করে। এ বিদ্যালয়কে তিনি নিজের জীবনের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত করে নিয়ে ছিলেন যে, “ইহার জীবনের অন্য সাধনা ও প্রচেষ্টার কথা ছাড়িয়া দিলেও শুধু এই স্কুলের জন্যই মুসলমান মান সমাজ ইহার নিকট চিরঋণী  হইয়া থাকিব।” বর্তমানে স্কুলটি সচল অবস্থায় কলকাতার ৯ নং লর্ড সিংহ রোড অবস্থিত।     

 

৭.

স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচলনা ক্ষেত্রে রোকেয়াকে নানারূপ সামাজিক প্রতিবন্ধকতা এবং বিদ্রুপ ও কুৎসার সস্মখীন হতে হয়েছে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমান সমাজের একটি অংশ তাঁর এই মহান প্রচেষ্টাকে বিনষ্ট করে দেবার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। রোকেয়ার আশা ছিল কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা স্কুল পরিচালনায় তাঁকে সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন। কিন্ত তাদের অধিকাংশই এ ব্যাপারে তাঁকে সহযোগিতা করেননি, বরঞ্চ তাঁর সাথে বৈরী আচরণ করেছেন। অনেকে স্কুল প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন এবং কুৎসা রটনা করেছেন। তাঁর নামে এমন অপবাদ দেয়া হয়েছিল, ‘যুবতি বিধবা স্কুল স্থাপন করিয়া নিজের রূপ-যৌবনের বিজ্ঞাপন করিতেছেন।’ এ অবস্থাতেও তিনি শক্ত মনোবল ও গভীর নিষ্ঠার সাথে তাঁর আরাধ্য কাজ করে গেছেন। দীর্ঘদিন স্কুল পরিচালনা করে ১৯২৯ সালে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এই আঠার বৎসর ধরিয়া এই গরীব স্কুলকে জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখিবার জন্য কেবল সংগ্রাম করিতে হইয়াছে।’ সমাজে নারী জীবনযাপন তখন কতখানি অসহনীয় ছিল তা তিনি বর্ণনা করেছেন তাঁর পরিণত বয়সে লেখা ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থে। সামাজিক এ পরিস্থিতিতে তিনি দুঃখ করে বলেছেন, “কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে, কেমন জন্ম লভিলাম পর্দানশীল ঘরে!” এখানে তার নারী হৃদয়ের হাহাকার প্রকাশ পেয়েছে। সমাজের সকল নারীর প্রতি তাঁর এক গভীর মর্মবেদনা ফুটে উঠেছে। বাংলার আরেক নারী দরদী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মর্মবেদনা থেকে উৎসারিত উচ্চারণের সাথে এর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। নারীর প্রতি, বিশেষত বিধবাদের প্রতি সমাজের হৃদেয়হীন উদাসীনতা ও অপমানিত আচরণের পরিচয় লাভ করে তিনি আপেক্ষ করেছিলেন, “হা অবলাগণ! তোমরা কি পাপে ভারতবর্ষে আসিয়া জন্মগ্রহণ করে, বলিতে পারি না”।

 

 

৮.

সামাজিক পীড়ন, মিথ্যাচারের অত্যাচার, কুৎসা-বিদ্রুপ, তিরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিদগ্ধজনের কাছ থেকে তিনি প্রশংসা ও সহয়তা  লাভ করেছিলেন। এদের মধ্যে সরোজিনী নাইডু, লেডি চেমসফোর্ড, আগা খান, মৌলানা মোহাম্মদ আলী, নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, সৈয়দ হাসান ইমাম, আবদুর রসূল, স্যার আবদুর রহিম, শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক প্রমুখজন। ১৯১৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সরোজিনী নাইডু হায়দরাবাদ থেকে বেগম রোকেয়াকেক একটি চিঠি লেখেন তাঁর কাজের প্রশংসা করে। তিনি লেখেন, “...কয়েক বৎসর হইতে দেখিতেছি, আপনি কি দুঃসাহসের কাজ করিয়া চলিয়াছেন। মুসলমান বালিকাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের জন্য আপনি যে কাজ হাতে নিয়াছেন এবং তাহার সাফল্যের জন্য দীর্ঘকালব্যাপী যে ত্যাগ সাধনা করিয়া আসিতেছের, তাহা বাস্তবিকই বিস্ময়কর আপনার প্রতি আমার আন্তরিক সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করিবার উদ্দেশ্যেই এই চিঠিখানা লিখলাম।’’

 

৯.

বেগম রোকেয়ার শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা ও কর্মবিচার বিশ্লেষণ করলে তাতে সামাজিক পরিপ্রক্ষিতের নতুন নতুন মাত্রা স্পষ্ট হয়ে আসে। শিক্ষার মাধ্যমে নারীর সামাজিক উত্তরণে তাঁর বাস্তববাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি সে সময়কার বাস্তবতার নিরিখে উদ্ভিদবিজ্ঞান, রসায়ন, উত্তাপতত্ত্ব প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করেন। এছাড়াও তিনি গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, সূচি বিদ্যা,শুশ্রুষা প্রণালী, সন্তান পালন প্রণালী প্রভৃতি বিষয় শিক্ষার ওপর গুরত্বারোপ করেছেন। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান আহরণ করে নারীরা যাতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হাতে পারে সে লক্ষ্যে তিনি তা করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি নানা যুক্তি- প্রমাণ দাঁড় করিয়েছেন। গৃহিনীদের ঘরকন্নার দৈনিক কাজগুল সূচারুরূপে সম্পাদন করবার জন্য বিশেষ জ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়োজনীতার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। বাসগৃহের পরিবেশ সুন্দরু ও স্বাস্থ্যসম্মত করা, পরিমিত ব্যয়ে সংসার পরিচালনা করার জন্য তিনি মেয়েদের প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। স্বাস্থ্যম্মত খাদ্য প্রস্তুত করতে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে তিনি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, “গৃহিণীর রন্ধন শিক্ষা করা উচিত, একথা কে অস্বীকার করেন ? একটা প্রবাদ আছে যে, স্ত্রীদের রান্না তাহাদের স্বামীর রুচি অনুসারে হয়। গৃহিনী যে খাদ্য করেন, তাহার উপর পরিবারস্থ সকলের জীবনধারণ নির্ভর করে। মূর্খ রাধুনীরা প্রায়ই ‘কালাই’ রহিত তাম্রপাত্রে দধি মিশ্রিত করিয়া কোর্মা প্রস্তত করে, তাহা বিষ ভিন্ন আর কিছু নহে; মুসলমানের প্রায়ই অরুচি, ক্ষুধামান্দ্য, অর্জীণ রোগ ভুগিয়া থাকেন, তাহার কারণ খাদ্যর দোষ ছাড়া আর কি হইতে পারে?” তিনি আরও বলেছেন, “রন্ধনপ্রণালীর সঙ্গে সঙ্গে গৃহিণীর ডাক্তারী ও রসায়ন বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান আবশ্যক। কোন খাদ্যের কি গুণ, কোন বস্ত কত সময়ে পরিপাক হয়, কোন ব্যক্তির নিমিত্ত কিরূপ আহার্য প্রয়োজন, এসব বিষয়ে গৃহিনীর জ্ঞান চাই।” রোকেয়া তাঁর ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে শিক্ষাকে বাস্তব জীবন সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে ‘বিদ্যালয়, কর্মালয় এবং আতুরাশ্রম’-কে একীভূত করার কথা চিন্তা করেছেন।

 

১০.

একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক পরিম-লের প্রেক্ষিতেই গড়ে উঠে একজন ব্যক্তির মানস কাঠামো। আর সেই মানসকাঠামোর ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় ব্যক্তির কর্মকা-। বেগম রোকেয়ার শিক্ষাচিন্তা ও কর্মকে বিশ্লেষণ করলে এই সত্যকেই অনুধাবন করা যায়। রোকেয়া ছিলেন এমনই এক মহিয়সী নারী। যুগের স্রষ্টা, সমাজ সংস্কারক, জ্ঞানের সাধক, মানবিক হৃদয়ের অধিকারী এবং এই শ্রেণীর মানুষই তো মহৎ থেকে মহত্তর হয়ে ওঠে। যুগে যুগে এরাই অমর, অক্ষয় ও মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থাকে। বেগম রোকেয়া শিক্ষাবিষয়ক চিন্তা ও কর্ম বিশ্লেষণে যে জিনিসটা সবকিছুর ওপর স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো, নারীকে তিনি সমাজে নিজের স্থান করে নেওয়ার যোগ্য করে তুলতে চেয়েছিলেন। তারঁ মধ্যে উগ্র নারীবাদের প্রকাশ কখনও ঘটেনি। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গ্রন্থে তিনি যে নারী প্রধান সমাজের কথা চিন্তা করেছেন, তা নিছক স্বপ্ন নয়। তার লক্ষ্যে যাতে বাস্তবে ফল লাভ করে সেজন্য শিক্ষাপ্রসার কর্মকান্ডের সাথে সাথে তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে মুসলিম মহিলা সমাজকল্যাণ সংস্থা গড়ে তোলেন। যে সময় বাঙালি মুসলিম সমাজের পুরুষেরা পদ ও পদবী লাভের আশায় মোসাহেবিতে ব্যস্ত সে সময় একজন নারী হয়ে  বেগম রোকেয়া প্রবল সাহস ও মনোবল নিয়ে সমাজ উন্নয়নের কাজে আত্মপ্রণোদনায় একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত ছিলেন। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমে যে-সব নারী লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন গভীরভাবে সমাজসচেতন ও যুক্তিবাদী, অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনে একনিষ্ট সংগঠক হিসেবে ছিলেন উজ্জ্বল পথিকৃৎ। এক আদর্শবাদী মানুষের প্রতিকৃতি রোকেয়া। সমাজ-সাহিত্য-নারী বিষয়ে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ হিসেবে তার উত্তর প্রজন্মের নারীরা তাঁর কাছ থেকে পেয়ে আসছেন অনুপ্রেরণা ও সংগ্রাম-অধিকার-জাগরণের প্রেষণা, যা এখনও এক প্রধান উৎসমূল।

 

(তথ্যসূত্র : রোকেয়া রচনাবলীসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট)

 

লেখকঃ মহুয়া মোহাম্মদ, গণমাধ্যমকর্মী

৮ ডিসেম্বর ২০২৫

 

সব খবর

আরও পড়ুন

পালাতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনায় উত্তাল এক দিন

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ পালাতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, কূটনৈতিক চাপ ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনায় উত্তাল এক দিন

স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে বাঙালি, বিশ্বরাজনীতির ময়দানে পাকিস্তানের পতন

একাত্তরের এই দিন | ৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে বাঙালি, বিশ্বরাজনীতির ময়দানে পাকিস্তানের পতন

৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের পথে মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানো এক দিন

জাতিসংঘে উত্তেজনা, রণাঙ্গনে দুর্বার অগ্রগতি ৪ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের পথে মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘোরানো এক দিন

ভারতে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারীদের হাতে ৪১৩ জনের মৃত্যু

নীলফামারীর গোলাহাট গণহত্যা ভারতে পৌঁছে দেবার প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারীদের হাতে ৪১৩ জনের মৃত্যু

আলাউদ্দিন খাঁর পুণ্যভূমিতে এ কোন অন্ধকার

তিতাসপাড়ের সুর আজ নিঃশব্দ আলাউদ্দিন খাঁর পুণ্যভূমিতে এ কোন অন্ধকার

২০২৫ সালে প্রবাসীদের জন্য সেরা দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ: জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংযোগে এগিয়ে যাঁরা

২০২৫ সালে প্রবাসীদের জন্য সেরা দেশগুলোর তালিকা প্রকাশ: জীবনযাত্রা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সংযোগে এগিয়ে যাঁরা

এক জীবনে কতজনকে সামলাতে পারে আমাদের মস্তিষ্ক?

সম্পর্কের সীমা জানে ‘নিওকর্টেক্স’ এক জীবনে কতজনকে সামলাতে পারে আমাদের মস্তিষ্ক?

হাওরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য ও জেলেদের জীবিকা

হাওরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ, হুমকিতে জীববৈচিত্র্য ও জেলেদের জীবিকা