অন্তর্বর্তী সরকার নতুন দুটি বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশনের লাইসেন্স দিয়েছে—যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক মহলে। ‘নেক্সট টিভি’ ও ‘লাইভ টিভি’ নামের দুটি চ্যানেলের অনুমোদন পাওয়া এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই দেখছেন “পুরোনো নীতিহীন ধারার পুনরাবৃত্তি” হিসেবে।
‘নেক্সট টিভি’র লাইসেন্স পেয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক মো. আরিফুর রহমান তুহিন। তিনি আগে একটি ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক ছিলেন এবং পরে এনসিপিতে যোগ দেন। অন্যদিকে, ‘লাইভ টিভি’-র লাইসেন্স পেয়েছেন আরিফুর রহমান নামে আরেকজন ব্যক্তি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করে সাংবাদিকতা করেছেন। তিনি এনসিপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে যোগ দেননি।
তাদের আর্থিক সামর্থ্য ও অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “নতুন টিভি অনুমোদন আগের প্রথা অনুযায়ী দেওয়া হয়েছে; সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির কাজ এখনও প্রক্রিয়াধীন।”
বর্তমানে বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমোদনের জন্য কোনো পৃথক আইন নেই। কেবল একটি জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা (২০১৪) রয়েছে, যেখানে বলা আছে—প্রত্যেক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানকে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু টেলিভিশন লাইসেন্স দেওয়ার জন্য কোনো স্পষ্ট নিয়মাবলি বা নীতিমালা এখনও গৃহীত হয়নি।
প্রচলিত নিয়মে আবেদনকারীদের জাতীয় পরিচয়পত্র, ইনকরপোরেশন সার্টিফিকেট, ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক সলভেন্সি সনদ, প্রকল্প প্রস্তাব ও চ্যানেল পরিচালনার সামর্থ্য সংক্রান্ত অঙ্গীকারনামা জমা দিতে হয়। এরপর তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যাচাই-বাছাই শেষে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এই প্রক্রিয়াকেই গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা “অস্বচ্ছ ও পক্ষপাতমূলক” বলে মন্তব্য করেছেন। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে—“দলীয় আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব” বেসরকারি টিভি অনুমোদনের প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
‘নেক্সট টিভি’র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২৪ জুন ‘৩৬ মিডিয়া লিমিটেড’-এর নামে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন বিএনপির সাবেক এমপি এ কে এম হাফিজুর রহমানের ছেলে গোলাম হাসনাইন, যিনি বর্তমানে সৌদি আরব বিএনপির সভাপতি।
অন্যদিকে, ‘লাইভ টিভি’ অনুমোদন পেয়েছে ১৪ জুলাই, যার মালিক আরিফুর রহমানের প্রতিষ্ঠান মিনার্ভা মিডিয়া লিমিটেড। তিনি জানান, “কাগজপত্রের কিছু কাজ চলছে, আশা করি আগামী বছর সম্প্রচারে যেতে পারব।”
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ৫০টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল অনুমোদিত, যার মধ্যে ৩৬টি সম্প্রচারে আছে এবং ১৪টি অপেক্ষমাণ।
দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা আশা করেছিলাম সব সিদ্ধান্ত হবে নিয়মনীতি মেনে, কিন্তু এখনো পুরোনো প্রক্রিয়াতেই চলছে। নীতিমালা ছাড়া টেলিভিশন অনুমোদন দেওয়া গণতান্ত্রিক সংস্কারের পরিপন্থী।”
তিনি বলেন, “দেশের অধিকাংশ টিভি আর্থিক সংকটে ভুগছে, কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে, বেতন বকেয়া। বিজ্ঞাপনের বাজারও ছোট হয়ে গেছে। এই অবস্থায় নতুন টিভি অনুমোদন কতটা যৌক্তিক, সেটি ভাবার বিষয়।”
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর নতুন টিভি অনুমোদন নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “যাদের নামে টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তারা নিজের পরিবার চালাতেও হিমশিম খায়। এটা অত্যন্ত অস্বচ্ছ ও প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্ত।”
তিনি আরও বলেন, “এই সরকার পরিবর্তনের পর আমরা আশা করেছিলাম ওয়ান-ইলেভেনের মতো স্বচ্ছতা আসবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আগের সরকারের মতোই ভাগ-বাটোয়ারা ও প্রভাববিস্তার চলছে। এতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দেওয়াকে শুরু থেকেই সমালোচনা করে আসা বর্তমান ‘নতুন বন্দোবস্তের’ সরকার পুরনো বন্দোবস্তের প্রতিচ্ছবিই এমনটাই মনে করছেন সমালোচকরা।