গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে আশাবাদ তৈরির পরও বাস্তবতায় হতাশা বাড়ছে। মার্চে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন সরকারকে যে সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন দিয়েছে, তার সাত মাস অতিবাহিত হলেও বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বরং সাংবাদিকদের পেশাগত সুরক্ষা আইন দ্রুত করতে কমিশন যে অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি করেছিল, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সেটিকে এমনভাবে পরিবর্তন করছে যে এটি প্রয়োগ হলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা আরও দুর্বল হতে পারে।
এমন বাস্তবতায় গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ, আইনগত সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রশ্নকে সামনে রেখে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশের গণমাধ্যমে সংস্কার: সুপারিশ, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। বুধবার বিকেলে হওয়া এ আয়োজনে সম্পাদক, সাংবাদিক, সংবাদপত্র মালিক, রাজনৈতিক দলের নেতা, গণমাধ্যম শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নেন। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, কমিশন প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য বিষয়গুলোর তালিকা দিতে বলা হয়েছিল। “এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আশু করণীয় তৈরি করে দিয়েছি। সরকারের উদ্যোগী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই দৃশ্যমান নয়।” তাঁর ভাষায়, সাংবাদিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য যে অধ্যাদেশের খসড়া কমিশন সরকারকে দিয়েছিল, মন্ত্রণালয় সেটি এমনভাবে পাল্টেছে, “যে সংস্করণটি কার্যকর হলে বরং আইন না করাই ভালো।”

ঢাকার জেলা আদালতে সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “আইন থাকলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল সাংবাদিককে রক্ষা করা। কিন্তু আইনের বদলে এখন সাংবাদিকদের ওপর মবের ভীতি তৈরি হয়েছে। লেখার আগে ভাবতে হচ্ছে, কার রোষানলে পড়ব।” তাঁর মন্তব্য, যে পরিবর্তনের আশায় মানুষ আন্দোলন করেছিল, সেই পরিবর্তনের সুফল এখনো দৃশ্যমান নয়। তবে তিনি মনে করেন, চাপ অব্যাহত রাখতে পারলে শেষ পর্যন্ত পরিবর্তন আসতে পারে।
ডেইলি স্টারের সম্পাদক এবং সম্পাদক পরিষদের সভাপতি মাহ্ফুজ আনাম বলেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম এখনো তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর ‘অস্বাভাবিকভাবে দায়বদ্ধ’। যত দিন এ নির্ভরতা কমবে না, স্বাধীন সাংবাদিকতা বিকাশ পাবে না। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর রাজনৈতিক বিভক্তিকে বড় বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, মালিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক সবার পেশাগত দায়িত্ব ও সীমা নির্ধারণে গণমাধ্যমপেশাজীবীদের স্বেচ্ছায় একটি ‘কোড অব এথিকস’ বা নীতিমালা করা জরুরি।
ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের সভাপতি রেজওয়ানুল হক বলেন, প্রচলিত বিভাজন এখনো কাটেনি। সম্প্রতি প্রেসক্লাবে একই সঙ্গে দুই ইউনিয়নের অফিস থাকা এবং পরবর্তীতে একদলের কাউকে তালাবদ্ধ করে বের করে দেওয়া—এ দৃশ্য প্রমাণ করে পরিবর্তন শব্দটি ‘শুধু স্লোগানে’ রয়েছে।

নোয়াব সভাপতি ও শিল্পপতি এ কে আজাদ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লিখিত প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে রাখতে হবে। তাঁর মতে, সংবাদপত্র স্বাধীন থাকলে শুধু সাংবাদিক নয়, সরকারও দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হয়। “গণতন্ত্র চাইলে গণমাধ্যমকে সহযোগিতা করতে হবে।”
রাজনৈতিক অংশগ্রহণকারীরাও হতাশা প্রকাশ করেন। নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রভাবমুক্ত সংবাদমাধ্যম একটি আন্দোলন, এ আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে। বিএনপির মিডিয়া সেলের প্রধান মওদুদ হোসেন আলমগীর প্রশ্ন তোলেন, “সত্যিকার অর্থে সংবাদপত্র কি কখনো স্বাধীন হতে চেয়েছে?” তিনি দাবি করেন, কমিশন গঠনের ঘোষণা শুধু ইশতেহারে নয়, বাস্তবায়নের স্পষ্ট পরিকল্পনা বিএনপি দেবে।
জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের প্রধান মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, হতাশার মধ্যেই পরিবর্তনের ইচ্ছা লুকিয়ে আছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, “৫ আগস্টের পর মিডিয়া দখলের চেষ্টা দেখেছি।” সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ঝুঁকি তিনি তুলে ধরে বলেন, নির্বাচনে মিডিয়ার অপব্যবহার হলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং কমিশনের সদস্য গীতি আরা নাসরীন বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে তারা স্বাধীন গণমাধ্যমকে কোন অবস্থানে দেখতে চায়। তিনি মন্তব্য করেন, “আমরা সুপারিশ দিয়েছি, বাস্তবতা ব্যাখ্যা করেছি। এখন সক্রিয় না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।”
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এস এম রিজওয়ান উল আলমের মতে, সংস্কারের সফল বাস্তবায়নে সাংবাদিক, মালিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় প্রয়োজন। আর কমিশনের সদস্য ও বিটিভির সাবেক কর্মকর্তা কামরুন্নেসা হাসান বলেন, বিটিভি প্রযুক্তিগতভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও বাস্তবে ‘দলীয় প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে চালানো হয়; ফলে বিরোধী মত বা ভিন্ন কণ্ঠস্বর সেখানে স্থান পায় না।
বণিক বার্তার সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, রাষ্ট্র মেরামতের আন্দোলন শুরু হলেও ‘রাষ্ট্র বা গণমাধ্যম, কোনো ক্ষেত্রেই মেরামত হয়নি’। এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান যৌথ প্ল্যাটফর্ম গঠনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, মালিক, সম্পাদক ও রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের অঙ্গীকার রাখতে হবে।

সার্বিক আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে, গণমাধ্যম সংস্কারের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবায়ন শূন্যের কোটায়। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বিভাজন সবকিছুর মাঝেই স্বাধীন সাংবাদিকতা এখনো ঝুঁকির মুখে। অংশগ্রহণকারীদের মতে, চাপ অব্যাহত ও স্পষ্ট নীতিগত অঙ্গীকার ছাড়া বাস্তব পরিবর্তন সম্ভব নয়।