ঢাকার একটি নতুন অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’-এর কর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের (২৮) আত্মহত্যার ঘটনায় শুরু হয়েছে নানা আলোচনা ও বিতর্ক। কর্মস্থলে ‘যৌন হয়রানি’ ও ‘বাজে আচরণ’-এর অভিযোগ ঘিরে যে টানাপোড়েন চলছিল, তারই প্রভাব এই মর্মান্তিক সিদ্ধান্তে পড়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ ও গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট মহল।
শনিবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল থেকে তার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বর্ণময়ী সোবহানবাগ এলাকার নাভানা টাওয়ারে ভাই ও ভাবির সঙ্গে থাকতেন। পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, বিকেলে পোশাক পরিবর্তনের কথা বলে কক্ষে ঢোকার পর অনেক সময় কোনো সাড়া না পাওয়ায় দরজা ভেঙে ফেলা হয়। ভেতরে তাকে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান বলেন, “প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যা বলেই মনে হচ্ছে। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। বাঁ হাতে কাটা দাগ পাওয়া গেছে, তবে কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায়নি।”
স্বর্ণময়ীর পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা জানান, তিনি দীর্ঘদিন মাইগ্রেনে ভুগছিলেন। তবে অফিস-সংক্রান্ত মানসিক চাপ তার মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছিল।
ঢাকা স্ট্রিমে যোগ দেওয়ার আট মাসের মাথায় স্বর্ণময়ীসহ ২৬ কর্মী গত জুলাই মাসে বাংলা কনটেন্ট সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে যৌন হয়রানি, মানসিক নিপীড়ন ও অশোভন আচরণের কথা উল্লেখ ছিল।
অভিযোগকারীদের একজন জানান, “আলতাফ শাহনেওয়াজ গভীর রাতে নারী সহকর্মীদের ফোন দিতেন, ব্যক্তিগত ও অনুপযুক্ত প্রশ্ন করতেন। কাজের চাপের অজুহাতে ভয়ভীতি দেখাতেন।”
অভিযোগের পর কর্তৃপক্ষ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং আলতাফকে বার্তাকক্ষ থেকে সাময়িক প্রত্যাহার করে। তবে তদন্তের ফলাফল নিয়ে কর্মীদের মধ্যে বিভক্ত মত দেখা দেয়।
ঢাকা স্ট্রিমের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক পি এম সজল আহমেদ বলেন, “তদন্তে আলতাফের কিছু ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’-এর প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। পরে অফিসে আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়।”
স্বর্ণময়ীর ঘনিষ্ঠজন ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মৌসুমী আচার্য্য বলেন, “স্বর্ণময়ী প্রায়ই অভিযোগ করত, অফিসে এক সহকর্মীর (আলতাফ শাহনেওয়াজ) আচরণে তার মনোবল ভেঙে যাচ্ছে। ওর ভাষায়, ‘উনি সবসময় আক্রমণাত্মকভাবে কথা বলেন।’”
তিনি আরও বলেন, “শুধু অফিস নয়, ব্যক্তিগত কিছু সমস্যাও ছিল তার। হয়তো সবকিছু মিলিয়েই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
আরেক স্বজন সঞ্জয় অধিকারী, যিনি একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক, বলেন, “আমরা বিষয়টি সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদের কাছে জানিয়েছিলাম। তখন মনে হয়েছিল সমস্যা মিটে গেছে।”
রবিবার রাতে ঢাকা স্ট্রিম এক বিবৃতিতে জানায়, “স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে তিন মাস আগের অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে প্রচারণা চলছে, তা বিভ্রান্তিকর।”
তবে অভিযোগকারীরা দাবি করছেন, তদন্তের ফলাফলের আগে তিনজন কর্মীর চাকরি না বাড়ানো হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন, শতাব্দীকা ঊর্মি, বলেন, “অভিযোগের পরই তিনজনকে বাদ দেওয়া হয়। অফিস বলছে ‘পারফরম্যান্স খারাপ’, কিন্তু সময়টা বলছে অন্য কথা।”
এই অভিযোগ অস্বীকার করে সজল আহমেদ বলেন, “অফিসে অনিয়মিত উপস্থিতি ও দুর্বল পারফরম্যান্সের কারণে তাদের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি।”
রোববার সন্ধ্যায় স্বর্ণময়ীর মরদেহ নিয়ে তার পরিবার ঝিনাইদহে রওনা হয়। ভাই সৌরভ বিশ্বাস সংক্ষেপে বলেন, “আমরা মরদেহ বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি, কিছু বলতে চাই না।”
এই মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের শোকই নয় বাংলাদেশের কর্মস্থল সংস্কৃতি, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।