বাংলাদেশে দরিদ্র পরিবারগুলো শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যে দ্বিমুখী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। একদিকে পাঁচ বছরের আগেই শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি তাদের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ, অন্যদিকে প্রসূতি মায়েরা ধনীদের তুলনায় অনেক কম স্বাস্থ্যসেবা পান।
ইউনিসেফের সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিক্স) ২০২৫–এর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারকে নিয়ে করা জরিপে দেখা গেছে দরিদ্রতম পরিবারের শিশু মৃত্যুর হার প্রতি এক হাজারে ৩৯ জন, যেখানে ধনী পরিবারে তা মাত্র ২২। মায়ের শিক্ষার সঙ্গেও শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। কোনো শিক্ষা নেই বা প্রাথমিক পর্যন্ত পড়েছেন এমন মায়েদের ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর হার ৪৮, আর উচ্চশিক্ষিত মায়েদের ক্ষেত্রে তা নেমে আসে ২২–এ।
গর্ভকালীন সেবা বা অ্যান্টিনেটাল কেয়ারে (এএনসি) ধনী-দরিদ্র ব্যবধান আরও স্পষ্ট। ধনী পরিবারের ৯৯ শতাংশ গর্ভবতী নারী অন্তত একবার এএনসি পেয়েছেন, দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৮৪ শতাংশ। গুণগত সেবায় ব্যবধান আরও বড়—গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার এএনসি নেওয়ার মানদণ্ড ধনী নারীদের ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ পূরণ হলেও দরিদ্র নারীদের মধ্যে তা মাত্র ২৩ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শফিউন নাহিন শিমুল বলেন, দরিদ্র ও কম শিক্ষিত শ্রেণির নারী-শিশুরা প্রায় সব সূচকেই পিছিয়ে। সরকারি খাতে স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সেবার অবদান কম থাকায় মানুষ বেসরকারি সেবার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যেখানে দরিদ্রদের প্রবেশাধিকার সীমিত। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক চাপ, মূল্যস্ফীতি ও খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে যাওয়াও দরিদ্র পরিবারের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়েছে।
জরিপে দেখা গেছে, দরিদ্রতম পরিবারের ৩২ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির; ধনীদের মধ্যে এ হার ১৬ শতাংশ। দরিদ্র পরিবারের ১৫ শতাংশ শিশু দুর্বলতা বা স্বল্পমেয়াদি অপুষ্টিতে ভোগে; ধনীদের মধ্যে এ হার ১০ শতাংশ। শিক্ষাক্ষেত্রেও বৈষম্য গভীর—দরিদ্র পরিবারের মাত্র ২১ শতাংশ শিশু উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করতে পারে, যেখানে ধনী পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ৬৬ শতাংশ।
প্রজনন হারেও বৈষম্য স্পষ্ট। দীর্ঘদিন কমার পর মোট প্রজনন হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৪–এ। দরিদ্রতম পরিবারের টিএফআর ২ দশমিক ৮, ধনীদের ২ দশমিক ২। ময়মনসিংহ বিভাগে টিএফআর সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৮, যেখানে সাক্ষরতার হারও সবচেয়ে কম।
কিশোরী মাতৃত্ব ও বাল্যবিয়ের হারও দরিদ্র পরিবারে বেশি। দরিদ্র পরিবারের প্রতি এক হাজার নারীর মধ্যে ১২০ জন কিশোরী বয়সে সন্তান জন্ম দিয়েছেন; ধনী পরিবারে এ হার ৬১। দেশে মোট নারীদের ৪৭ শতাংশের বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে, দরিদ্র পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ৬৫ শতাংশ।
সিজারিয়ান সেকশনে সন্তান জন্মের হার ধনী পরিবারে ৬৮ শতাংশ, দরিদ্রদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ। তবে শিশুদের জন্মের পর দ্রুত বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দরিদ্র নারীরা এগিয়ে—৩৮ শতাংশ বনাম ধনী নারীদের ২৪ শতাংশ।
সব মিলিয়ে জরিপ বলছে, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত বৈষম্য নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জীবনমানকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ মনোযোগ ও কার্যকর নীতি ছাড়া এ বৈষম্য কমানো সম্ভব নয়।