সর্বশেষ

জন্মদিনে পথিকৃতের প্রতি শ্রদ্ধা

অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সমাজদর্শনে বেগম রোকেয়া

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:০০
অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সমাজদর্শনে বেগম রোকেয়া

নারী জাগরণের অগ্রদূত, শিক্ষাবিদ ও লেখক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৮০–১৯৩২) ১৪৬তম জন্মদিন আজ। অসাম্প্রদায়িক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের যে কল্পনা তিনি এক শতাব্দী আগে উপস্থাপন করেছিলেন, তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রদায়িক সংঘাত, লিঙ্গবৈষম্য কিংবা সামাজিক সংকট অতিক্রম করে মানবিক, শিক্ষিত ও প্রগতিশীল জাতি গঠনের যে দর্শন রোকেয়া লালন করেছিলেন, তা তার সাহিত্য ও সক্রিয় জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রকাশ পেয়েছে।

 

দ্বৈত বাংলায় স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫–১৯১১) থেকে শুরু করে গান্ধীর স্বরাজ আন্দোলন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়া ছিল ধর্মীয় বৈরিতা ও বিভাজনের উত্তাপে উত্তাল। ঢাকা, কানপুর, কাশ্মীর ও ভেলোরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তার জীবনকালে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অংশ ছিল। তবুও তিনি বিশ্বাস হারাননি যে হিন্দু–মুসলিম ঐক্য ছাড়া আধুনিক, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভারত (এবং আজকের বাংলাদেশ) গড়া সম্ভব নয়।

 

গভীরভাবে ধর্মপ্রাণ হলেও রোকেয়া কখনও সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। কোরান পাঠ, নিয়মিত নামাজ এবং মুসলিম নারীর মুক্তি তার কাজের কেন্দ্রবিন্দু হলেও তিনি সর্বদা নারীর সার্বিক মুক্তিকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। এ কারণেই মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯১১ সালে কলকাতায় স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় তিনি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ব্রাহ্ম ও হিন্দু বিদ্যালয়ে নিয়মিত যেতেন। সেখানেই গড়ে ওঠে পি.কে. রায়ের মতো শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আজীবনের বন্ধুত্ব। রোকেয়ার মৃত্যুর পর আলবার্ট হলে আয়োজিত স্মরণসভায় বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাকে সম্মান জানাতে উপস্থিত হন। সভাপতি পি.কে. রায় বলেন, “তিনি জানতেন যে শুধু আচার–অনুষ্ঠানই ধর্ম নয়; মানবকল্যাণই প্রকৃত ধর্ম।”

 

তার লেখায় এই অসাম্প্রদায়িক বোধ স্পষ্ট। “সুগৃহিণী” প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন, “আমরা প্রথমত ভারতীয়, পরে হিন্দু-মুসলমান।” আবার “এডুকেশনাল আইডিয়ালস ফর দ্য মডার্ন ইন্ডিয়ান গার্ল” প্রবন্ধে উপনিষদ ও গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন নিজস্ব ঐতিহ্যের ভাল উপাদান গ্রহণের পাশাপাশি পশ্চিমের উপযোগী জ্ঞান গ্রহণ করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক করতে হবে। এভাবেই তিনি পূর্ব–পশ্চিম মিলিয়ে এক সমন্বিত আধুনিকতার ধারণা দেন।

 

তার রচনায় হিন্দু পুরাণ ও দেবী–চরিত্র যেমন উপস্থিত, তেমনি মুসলিম ও হিন্দু নারীদের যৌথ সংগ্রামও উঠে এসেছে। “নারী সৃষ্ট্তি”, “সৃষ্টিতত্ত্ব”, “নার্স নেলি”, “নারীপূজা”, “গৃহ” কিংবা “অবরোধবাসিনী”—সবখানেই দেখা যায় হিন্দু-মুসলমান নারীদের একই নিপীড়নব্যবস্থায় আবদ্ধ হওয়ার অভিজ্ঞতা। তিনি স্পষ্ট করেছেন নারীর অবস্থা কোনো ধর্মে ভিন্ন নয়; পুরুষতন্ত্র সর্বত্রই নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে।

 

তার অসাম্প্রদায়িক মননের সঙ্গে যুক্ত ছিল সংহতি, প্রেম ও মানবিকতার বৈশ্বিক বোধ। “প্রেমরহস্য” গল্পে তিনি লিখেছেন,“আমি সব ধর্মের মানুষকে ভালোবাসি—হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান।” নিজের জীবনে তিনি চাম্পা নামের এক দলিত কিশোরী, এক ইংরেজ মহিলা এবং উত্তর ভারতের এক বৃদ্ধার সঙ্গে গভীর মানবিক বন্ধন গড়ে তুলেছিলেন।

 

রোকেয়ার প্রগতিশীল কল্পনার সর্বোচ্চ প্রতিফলন তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক কাল্পনিক গল্প সুলতানার স্বপ্নে যেখানে নারী বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন সৌরশক্তিচালিত প্রযুক্তি, উড়ন্ত যান, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও স্বয়ংক্রিয় কৃষি ব্যবস্থা। আজকের স্মার্ট প্রযুক্তির যুগে এই কল্পনা বাস্তবতার কাছাকাছি বলেই মনে হয়।

 

জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে—৯ ডিসেম্বর—এক বিরল ঘটনাও বটে। মৃত্যুর আগের রাতেও তিনি লিখছিলেন “নারীর অধিকার” বিষয়ে। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন নারী মুক্তি, শিক্ষা ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য।

 

আজ তার জন্মদিনে প্রশ্ন একটাই, আমরা কি সেই অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজের পথে এগোতে পেরেছি, যার স্বপ্ন তিনি শত বছর আগে দেখেছিলেন?

সব খবর

আরও পড়ুন

বেগম রোকেয়াকে ‘মুরতাদ-কাফির’ বললেন রাবি শিক্ষক

অন্তর্জালে তীব্র প্রতিক্রিয়া বেগম রোকেয়াকে ‘মুরতাদ-কাফির’ বললেন রাবি শিক্ষক

বেড়েছে অনলাইন সহিংসতা, ১০ জনে ৭ নারী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক ডিজিটাল নির্যাতনের শিকার

জাতিসংঘের প্রতিবেদন বেড়েছে অনলাইন সহিংসতা, ১০ জনে ৭ নারী মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক ডিজিটাল নির্যাতনের শিকার

দরিদ্র পরিবারে শিশু-মৃত্যু বেশি, মায়েদের স্বাস্থ্যসেবায় তীব্র বৈষম্য

পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের জরিপ দরিদ্র পরিবারে শিশু-মৃত্যু বেশি, মায়েদের স্বাস্থ্যসেবায় তীব্র বৈষম্য

নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, একে দমন করতে হবে

মহিলা পরিষদের সংবাদ সম্মেলন নারীবিদ্বেষী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে, একে দমন করতে হবে

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস আজ

বাড়ছে পারিবারিক সহিংসতা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস আজ

২০২৪ সালে প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী হত্যা

জাতিসংঘের ভীতি সঞ্চারক প্রতিবেদন ২০২৪ সালে প্রতি ১০ মিনিটে একজন নারী হত্যা

অক্টোবরে দেশে ২৩১ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার

মহিলা পরিষদের বিবৃতি অক্টোবরে দেশে ২৩১ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার

গণমাধ্যমকর্মী স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি

২৪৩ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি গণমাধ্যমকর্মী স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি