বাংলাদেশে চিকিৎসক ও নার্সদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। ফলে তরুণ ও দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীরা বিদেশমুখী হচ্ছেন, যা জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সংকট তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিরাজগঞ্জের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করা তরুণ চিকিৎসক ডা. আব্দুল মুকিত জানান, ঢাকার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে এমবিবিএস ডিগ্রিধারীরা মাসে গড়ে ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা বেতন পান। এতে নতুন চিকিৎসকরা অর্থকষ্টে পড়ছেন এবং কর্মস্পৃহা হারাচ্ছেন।
সম্প্রতি অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস, বাংলাদেশ (এএইচআরবি) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের চিকিৎসকদের বার্ষিক গড় বেতন মাত্র ৩ লাখ টাকা। অন্যদিকে ভারতে চিকিৎসকরা বছরে গড়ে ১৬ লাখ ৪৪ হাজার, নেপালে ১০ লাখ ৩২ হাজার, শ্রীলঙ্কায় ৪ লাখ ৮০ হাজার এবং পাকিস্তানে ৪ লাখ ১০ হাজার টাকা আয় করেন। উন্নত বিশ্বের চিত্র আরও বৈষম্যমূলক—যুক্তরাজ্যে একজন চিকিৎসক বছরে প্রায় ৯৮ লাখ টাকা পান, যা বাংলাদেশের চিকিৎসকদের তুলনায় ৩৩ গুণ বেশি।
বাংলাদেশি নার্সদের পরিস্থিতিও একই রকম। দেশে একজন নার্স বছরে গড়ে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা বেতন পান। কিন্তু ভারতে একজন নার্সের গড় বার্ষিক আয় ৬ লাখ ৯০ হাজার, নেপালে ৫ লাখ ২০ হাজার, শ্রীলঙ্কায় ২ লাখ ৪০ হাজার এবং পাকিস্তানে ১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। যুক্তরাজ্যের নার্সদের আয় বাংলাদেশি নার্সদের তুলনায় প্রায় ২৫ গুণ বেশি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় কম বেতন পান। পারফরম্যান্সভিত্তিক ইনসেনটিভ ব্যবস্থা এখানে নেই, যা অন্য দেশে প্রচলিত। নিরাপত্তা, প্রমোশন ও অন্যান্য সুবিধার ক্ষেত্রেও চিকিৎসকরা বঞ্চিত হচ্ছেন।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের চিকিৎসক ডা. আলী আফতাব বলেন, সরকারি চাকরিতে ক্যাডারভিত্তিক বেতন কাঠামোর কারণে চিকিৎসকদের বিশেষ দক্ষতা ও বাজারমূল্যের প্রতিফলন বেতনে নেই। সরকারি চিকিৎসকদের কম বেতনের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ দেওয়া হয়, কিন্তু এটি টেকসই সমাধান নয়।
এএইচআরবি আয়োজিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকারি খাতে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার, আর বেসরকারি খাতে ১ লাখ ৯০ হাজার। কিন্তু উভয় খাতেই কর্মীদের ন্যায্য বেতন কাঠামো নেই। এতে সেবার গুণগত মান, দক্ষতা ও প্রেরণা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আলোচনা সভায় জাতীয় অধ্যাপক ডা. একে আজাদ খান বলেন, “একজন সিভিল সার্জনকে তার প্রাপ্য বেতন দেওয়া হয় না। বেতন কাঠামোর পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে।”
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, তরুণ চিকিৎসকরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। এ অবস্থা পরিবর্তন জরুরি।
সভায় সুপারিশ করা হয়—স্বাস্থ্য খাতের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন, দুর্গম এলাকায় কর্মরতদের জন্য বিশেষ ভাতা, বেসরকারি খাতে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ এবং কর্মদক্ষতা ও রোগীর সন্তুষ্টির ভিত্তিতে প্রণোদনা চালু করার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যায্য বেতন কাঠামো ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না করলে স্বাস্থ্য খাত থেকে মেধাপাচার আরও বাড়বে এবং দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়বে।