বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে আইনজীবীদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার ওপর ধারাবাহিক দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছে। এ পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ১৫টি দেশ-বিদেশের মানবাধিকার ও আইনী প্রতিষ্ঠান।
ফ্রান্সভিত্তিক হিউম্যান রাইটস সংগঠন জাস্টিসমেকারস বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (JMBF)-এর নেতৃত্বে দ্য কাউন্সিল অব বারস অ্যান্ড ল অব সোসাইটিস অব ইউরোপ (CCBE), দ্য ন্যাশনাল বার কাউন্সিল (CNB), দ্য ইন্টারন্যাশনাল অবজারভেটরি অব লইয়ার্স অ্যাট রিস্ক (OIAD), দ্য অ্যারেস্টেড লইয়ার্স ইনিশিয়েটিভ, দ্য অ্যারাব সেন্টার ফর দ্য ইন্ডিপেনডেন্স অব দ্য জুডিশিয়ারি অ্যান্ড দ্য লিগ্যাল প্রফেশন (ACIJLP), দ্য ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব পিপলস লইয়ার্স – মনিটরিং কমিটি অন অ্যাটাকস অন লইয়ার্স, দ্য পিপলস ভিজিল্যান্স কমিটি অন হিউম্যান রাইটস (PVCHR), বাংলার মানাবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (MASUM), দ্য নেভার এগেইন অ্যাসোসিয়েশন, দ্য এশিয়া প্যাসিফিক রিফিউজি রাইটস নেটওয়ার্ক (APRRN), দ্য পাবলিক অ্যাসোসিয়েশন ডিগনিটি, প্রোগ্রাম অ্যাগেইনস্ট কাস্টোডিয়াল টর্চার অ্যান্ড ইমপিউনিটি (PACTI), ইন্টারন্যাশনাল এলজিবিটিকিউআই সলিডারিটি (SIL), ফ্যামিলিস অব দ্য ডিসঅ্যাপিয়ার্ড (FOD) যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশে আইনজীবীরা রাজনৈতিক মতামত, পেশাগত দায়িত্ব ও সাংগঠনিক সম্পৃক্ততার কারণে পরিকল্পিতভাবে হয়রানি, গ্রেপ্তার, হামলা, হত্যার শিকার হচ্ছেন।
JMBF-এর সর্বশেষ নথিভুক্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ২৬৮টি যাচাইকৃত ঘটনায় ৮৪৯ আইনজীবী বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। সংগঠনটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
সমন্বিত রাজনৈতিক অভিযানের অভিযোগ
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ও তার মিত্ররা আইনজীবীদের রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে পরিকল্পিত দমননীতি পরিচালনা করছে। এতে বিচারপ্রার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, আদালত-সংক্রান্ত কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে এবং আইনের শাসন দুর্বল হচ্ছে।
JMBF-এর নথি অনুযায়ী দমন–পীড়নের ধরন:
মিথ্যা ও সাজানো মামলা
২০০টি ঘটনায় ৭২১ আইনজীবী ‘হত্যা’, ‘খুনের চেষ্টা’, ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র’, ‘সাবোটাজ’, ‘চাঁদাবাজি’সহ নানা অভিযোগে হয়রানির শিকার। এসব মামলা আইনজীবীদের নীরব ও অসাড় করে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে দাবি।
ইচ্ছাকৃত আটক ও কারাবাস
৭৫টি ঘটনায় ২০৩ ভুক্তভোগী, তাদের মধ্যে ৫৭টি ঘটনায় ৭৩ আইনজীবী গ্রেপ্তারের পর আটক এবং ১৮টি ঘটনায় ১৩০ আইনজীবী আদালতে আত্মসমর্পণের পর কারাবন্দি।
শারীরিক হামলা
২৬ ঘটনায় ৫১ আইনজীবী হামলা, ভয়ভীতি ও হয়রানির শিকার। মাঠে, আদালত ও নিজ বসতবাড়ির আশপাশেও হামলার অভিযোগ রয়েছে।
টার্গেট করে হত্যা
৪ আইনজীবীকে আদালতের বাইরে হত্যা করা হয়েছে যা আইনজীবী মহলে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
ভাঙচুর ও নিপীড়ন
৭ ঘটনায় আইনজীবীদের চেম্বার, বাড়ি ও অফিসে হামলা চালানো হয়েছে। এতে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবন ব্যাহত হয়েছে।
পেশাগত নিষেধাজ্ঞা ও শাস্তি
১৬ ঘটনায় আইনজীবীদের লাইসেন্স বাতিল ও বার থেকে বহিষ্কার। এতে তাদের পেশাগত নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বার কমিটি দখল ও নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ
১৬টি বারে জোরপূর্বক কমিটি দখলের অভিযোগ, আর ৪৪ জেলা বারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের মনোনয়ন বাতিল বা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।
অন্যান্য নিপীড়ন
৩০ ঘটনায় ৫০ জন আইনজীবী নজরদারি, হুমকি, মিথ্যাচার করে চরিত্রহনন, হয়রানি, মৃত্যু-হুমকি ও মিথ্যামামলার ভয় পেয়েছেন।
কাদের উপর বেশি টার্গেট?
JMBF-এর তথ্য অনুযায়ী, দমন-পীড়নের ৮৮% ঘটনা এবং ৯৩% ভুক্তভোগী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ আইনজীবী। সংগঠনগুলো বলছে, এটি রাজনৈতিকভাবে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশ্যেই পরিচালিত।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ ও দাবি
যৌথ বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে—
এছাড়া জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল, ইউরোপীয় সংসদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নেটওয়ার্কগুলোকে বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাস্টিসমেকারস বাংলাদেশ ইন ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট শাহানুর ইসলাম বলেন, “আইনজীবীরা যদি নিরাপদ না হন, বিচারব্যবস্থা কখনও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতি শুধু আইনজীবীদের নয়, দেশের বিচারব্যবস্থার ভিত্তিকে দুর্বল করছে।”
যৌথ বিবৃতির শেষে সংগঠনগুলো ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও আইনের শাসন রক্ষায় তাদের অটল প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।