বাংলাদেশে ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্কিত। অপরাধের অস্পষ্ট সংজ্ঞা, নির্বিচারে প্রয়োগ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অভিযোগে আইনটি সমালোচনার মুখে পড়ে। জুলাই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে এই আইনের প্রয়োগ আবারও আলোচনায় এসেছে। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারায় গোপন বৈঠকের অভিযোগ এনে মেজর সাদেকুলের স্ত্রী সুমাইয়া তাহমিদ যাফরিন, আওয়ামী লীগের মিছিলে অংশগ্রহণের অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম এবং একাত্তর মঞ্চের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার অভিযোগে আবু আলম শহীদ খানসহ অনেককে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে।
২০০৪ সালে আইনটির আলোচনা শুরু হয় এবং ২০০৯ সালে এটি সংসদে পাস হয়। এর আগে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশ জারি করে। আইনটি ২০১২ ও ২০১৩ সালে সংশোধিত হলেও সুশীল সমাজ ও বিরোধী দলগুলোর মতামত উপেক্ষিত ছিল। সংশোধনীর সময় বিরোধী সংসদ সদস্যরা ওয়াকআউট করে প্রতিবাদ জানান।
২০২৫ সালের মে মাসে ‘সন্ত্রাসবিরোধী সংশোধন অধ্যাদেশ’ অনুমোদিত হয়, যেখানে ব্যক্তি বা সত্তার কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিধান যুক্ত করা হয়। সম্পাদক পরিষদ এই নতুন ধারাকে সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করে পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, “এই আইন মতপ্রকাশ, জীবন ও জীবিকার অধিকার দমন করতে পারে। বিস্তৃত সংজ্ঞার কারণে কর্তৃপক্ষ চাইলে যেকোনও ভিন্নমতাবলম্বীকে টার্গেট করতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “২০২৫ সালের সংশোধনী রাজনৈতিক দল ও জনসমাগম নিষিদ্ধ করতে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।”
গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ‘মঞ্চ ৭১’-এর সদস্যদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি মানবাধিকারের লঙ্ঘন। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে হত্যা মামলাসহ ঢালাওভাবে মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষকেও আটকানো হচ্ছে। গণতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে বের না হলে তা অর্থহীন হয়ে পড়বে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ল’ অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ ছাড়া কাউকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে হেনস্তা করা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আইনটির অপব্যবহার এখন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অনেক গুণীজনও এই আইনের শিকার হচ্ছেন। এই অপব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করা জরুরি।”
বিশ্লেষকদের মতে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনটি সময়োপযোগী সংস্কার ও স্বচ্ছ প্রয়োগ ছাড়া গণতান্ত্রিক পরিবেশে আস্থার সংকট সৃষ্টি করবে।