বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে নতুন সংশোধিত সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করছে—এমন অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও শান্তিপূর্ণ মতপ্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগের ঘটনা বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়কে (OHCHR) অবিলম্বে এই বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি জানাতে হবে এবং রাজনৈতিক সহিংসতার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন রোধে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে তিন সপ্তাহব্যাপী সহিংস বিক্ষোভে অন্তত ১,৪০০ জন নিহত হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এরপর ২০২৫ সালের ১২ মে সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কঠোর সংশোধনী ব্যবহার করে আওয়ামী লীগকে “সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ” ঘোষণা করে। এর আওতায় দলের সভা, প্রকাশনা ও অনলাইন বক্তব্য নিষিদ্ধ করা হয়—যা বর্তমানে গ্রেপ্তার অভিযানের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, “বাংলাদেশিরা শেখ হাসিনা সরকারের সময় পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ দেখেছে। অন্তর্বর্তী সরকার যেন সেই একই পথে না হাঁটে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়কে এখনই হস্তক্ষেপ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার ঠেকাতে হবে।”
সংস্থাটি জানায়, হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; অনেককেই দুর্বল অভিযোগে হত্যা মামলার আসামি বানানো হয়েছে। কয়েকজন আটক ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে না—যা অতীত সরকারের নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।
গত ২৮ আগস্ট ঢাকার রিপোর্টার্স ইউনিটিতে “মঞ্চ ৭১” আয়োজিত একটি আলোচনাসভা থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা সহ ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস প্রচারে কাজ করা ওই সংগঠনের সভায় হামলা চালায় একদল উগ্রপন্থী; কিন্তু হামলাকারীদের পরিবর্তে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন অংশগ্রহণকারীরাই। তাঁদের মধ্যে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান এবং সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী।
পরে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হয়। পুলিশ দাবি করে, তারা সরকারের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দিচ্ছিলেন—যা প্রত্যক্ষদর্শীরা অস্বীকার করেছেন। ৪ সেপ্টেম্বর জামিন শুনানিতে সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্নাকে হেলমেট, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট ও হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আদালতে হাজির করলে ব্যাপক সমালোচনা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ২০২৫ সালের সংশোধনীগুলোকে সরকার “ন্যায়বিচারের প্রয়োগ” হিসেবে ব্যাখ্যা করলেও, সম্পাদক পরিষদ সতর্ক করেছে—এতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের পরিসর সীমিত হবে। তবে অনুমেয়ভাবেই ড. ইউনূস এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এদিকে, বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৫২ জন মব হামলায় নিহত হয়েছেন। সংগঠনের মতে, সরকার একদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মীয় উগ্রবাদী সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে।
২০২৫ সালের জুলাইয়ে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার সহযোগিতার জন্য তিন বছর মেয়াদি এক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান ভলকার টুর্ক বলেছেন, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রতিশ্রুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে গাঙ্গুলি বলেন, “সন্ত্রাসবিরোধী আইনকে রাজনৈতিক দমনের অস্ত্রে পরিণত করা ঠিক হবে না। সরকারের উচিত নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা।”