খাগড়াছড়িতে এক কিশোরী ধর্ষণ ও পরবর্তীতে বিচার দাবিতে আন্দোলনের সময় গুলি চালিয়ে তিন আদিবাসী নিহত হওয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা উঠেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাহাড়ের জটিল সমস্যা বুঝতে না পেরে শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা কেবল পরিস্থিতিকে আরও অবনতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ধর্ষণ অভিযোগ থেকে সহিংসতায় রূপান্তর
গত ২৩ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে এক আদিবাসী কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করলেও আন্দোলনকারীদের দাবি ছিল তিনজন অভিযুক্তকে আটক করতে হবে। জুম্ম ছাত্র-জনতা ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। দাবি পূরণ না হওয়ায় ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে খাগড়াছড়ি অবরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে।
অবরোধ চলাকালে মহাজনপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট ও ঘরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়। ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারায় আন্দোলন দমনে গুলি চালালে তিন আদিবাসী নিহত ও অন্তত ২০ জন আহত হন। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে স্থানীয় বাঙালিরাও সহিংসতায় অংশ নেয়।
প্রশাসনের সমালোচনা
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, ধর্ষণের মতো অপরাধে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেত। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, “একজন ধর্ষককে আটক করা কঠিন কাজ ছিল না। কিন্তু তা না করে আন্দোলন দমন করতে গুলি চালানো হলো।”
মহিলা কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত এক বছরে খাগড়াছড়িতে সাতজন পাহাড়ি নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে অন্তত তিনটি। সংগঠনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর মনীষা তালুকদার অভিযোগ করেন, “ডাক্তারি পরীক্ষা থেকে শুরু করে মামলা নেওয়া পর্যন্ত সব জায়গায় গড়িমসি করা হয়। এতে প্রমাণ নষ্ট হয়, আসামিরা সহজে জামিন পেয়ে যায়।”
বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সভাপতি ওয়াইবাই মারমা বলেন, “ধর্ষণের শিকাররা আদিবাসী হলেও ধর্ষকরা সাধারণত বাঙালি। মামলা করতে গেলেই প্রশাসন নিরুৎসাহিত করে, প্রভাবশালীরা টাকা দিয়ে মীমাংসা করিয়ে নেয়।”
সরকারের দায় চাপানো ও একপাক্ষিক বিবৃতি
সাম্প্রতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারের বক্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, ‘‘ভারত বা ফ্যাসিস্টদের ইন্ধনে এ ঘটনা ঘটছে।” অপরদিকে আইএসপিআর ও স্থানীয় সেনা কর্মকর্তারা ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন। মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির বলেন, “আইএসপিআরের বিবৃতি পুরোপুরি একপাক্ষিক। এতে আদিবাসীদের আস্থা ভেঙে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘আমরা কি এই দেশের নাগরিক নই? তাহলে কেন নাগরিক অধিকার, মানবাধিকার, ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা হচ্ছে না?”
দীর্ঘমেয়াদি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ধর্ষণ ইস্যুতে সহিংসতা হলেও এর পেছনে পাহাড়িদের জমি দখল, উচ্ছেদ, বৈষম্য, এবং শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যর্থতা দীর্ঘদিনের ক্ষোভ হিসেবে কাজ করছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, “রাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি দিয়ে পাহাড়িদের সাথে প্রতারণা করেছে। সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া শান্তি আসবে না।”
মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র
জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০০টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয় হাজারের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, ২১ জন নিহত হয়েছেন এবং শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ হয়েছে।
রাজনৈতিক সমাধানের দাবি
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শক্তি প্রয়োগ নয়, বরং সংলাপ ও শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই পাহাড়ি সংকটের স্থায়ী সমাধান আনতে পারে। মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘অভিযুক্তদের সঠিক বিচার না হলে নতুন করে সহিংসতা ঘটতেই থাকবে।”