জুলাই সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নিরাপত্তা বাহিনীর বেপরোয়া অভিযান, সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও অধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র সামনে এসেছে।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার তাদের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে কমপক্ষে ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য—গত তিন মাসেই ঘটেছে ১১টি হত্যাকাণ্ড, অর্থাৎ মাসে গড়ে তিনটির মতো।
যে দল, সংগঠন ও ব্যক্তিরা অতীতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ছিলেন, ঠিক তাদেরই ক্ষমতার সময়ে এই ধরনের ঘটনাই এখন অব্যাহত—এ বিষয়টি দেশব্যাপী প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে।
অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, এ সময়ে গুলিতে ১৯ জন, নির্যাতনে ১৪ জন এবং হেফাজতে পিটিয়ে সাত জনের মৃত্যুর ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সংঘটিত ১১টি হত্যার মধ্যে সাতটিতে যৌথবাহিনী, তিনটিতে পুলিশ এবং একটি ঘটনায় সেনা সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
এমনকি, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনায় যৌথবাহিনীকে দায়ী করেছে সংস্থাটি সাত ক্ষেত্রে, পুলিশকে তিন ক্ষেত্রে এবং একটি ঘটনায় সেনা সদস্য সংশ্লিষ্ট বলে প্রতিবেদন উল্লেখ করে।
যে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ইস্যু নিয়ে তীব্র সমালোচনা ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই সময়কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরাই এখন ক্ষমতায় থেকেও একই ধরণের ঘটনা বন্ধে ব্যর্থ এমন প্রবল প্রশ্ন জনমনে দেখা দিয়েছে। শুধু বিচারবহির্ভূত হত্যা নয়, অধিকার বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসে কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৮৮ জনের, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৫ বাংলাদেশি। গত মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২,৩৩৩ জন বাংলাদেশিকে সীমান্তে পুশ-ইন করা হয়েছে। যেখানে অতীতে এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল, সেখানে এখন দায়িত্বে থাকা সরকার এ ধরনের ঘটনাগুলো ঠেকাতে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় ২৮১ জন নিহত হয়েছেন। নারী নির্যাতনেও বড় উল্লম্ফন দেখা যায়—১৪ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৬৮৭ জন নারী, যার মধ্যে মাত্র তিন মাসেই ভুক্তভোগী ১৮৮ জন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে কেন্দ্র করে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “মানবাধিকার রক্ষার নামে ক্ষমতায় আসা সরকার দেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।”
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মহলে র্যাব ইস্যুকে বড় করে দেখানো হলেও অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে বাহিনীটির কোনো কাঠামোগত সংস্কার নেয়নি। জাতিসংঘের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও জবাবদিহির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও দুর্বল হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, “মানবাধিকার রক্ষার নামে যারা সরকার পরিবর্তন করল, তারাই বিচারবহির্ভূত হত্যা, সীমান্তে মৃত্যু ও নারীর উপর সহিংসতা থামাতে ব্যর্থ। এটি সুস্পষ্ট দ্বিচারিতা।”
মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েই অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতি, নারী নির্যাতন, কারা মৃত্যু, সীমান্তসহ সব ক্ষেত্রেই চিত্র আরও ভয়াবহ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ। এখন জনমনে প্রশ্ন—যারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার ইস্যু তুলে আন্দোলন করেছিল, তাদের শাসনামলে কি সত্যিই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, নাকি কেবল সরকারের নাম বদলেছে—ব্যবস্থা নয়?