সর্বশেষ

নেপালে জেন-জেড আন্দোলন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা থেকে সহিংসতা, সেনা মোতায়েন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা

প্রকাশিত: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:১৫
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা থেকে সহিংসতা, সেনা মোতায়েন ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা

নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকেই যে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত, তা এখন দেশজুড়ে তীব্র সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি, এর আগে তাঁর একাধিক মন্ত্রীও পদত্যাগ করেছেন। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবন, প্রেসিডেন্ট ভবন, মন্ত্রীদের বাসভবন ও সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়। সোমবারে অন্তত ১৯ জন নিহত ও কয়েকশ’ আহত হন, মঙ্গলবারও আরও দুজন নিহত হন।

 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষেধাজ্ঞা থেকে আন্দোলনের বিস্ফোরণ

 

গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে নেপালে ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ও লিংকডইনের মতো ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপ বন্ধ করে দেয় সরকার। সরকারের অভিযোগ ছিল, এসব প্ল্যাটফর্মে ভুয়া তথ্য, ঘৃণা ছড়ানো ও সাইবার অপরাধ বাড়ছে এবং বিদেশি কোম্পানিগুলো নিয়ম মানছে না। যদিও টিকটক, ভাইবার, উইটকসহ পাঁচটি অ্যাপ নিবন্ধন করায় সচল ছিল।

 

কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নেপালি তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে থেকেই জনপ্রিয় ছিল নেপো কিডস বা নেপো বেবিস হ্যাশট্যাগ—যেখানে নেতাদের সন্তানের বিলাসবহুল জীবনযাপন ও সাধারণ মানুষের বেদনাদায়ক বাস্তবতার তুলনা করা হচ্ছিল। ভাইরাল হওয়া একটি স্লোগান ছিল, “তাদের সন্তানেরা গুচির ব্যাগ নিয়ে ফেরে, আমাদের সন্তানেরা কফিনে ফেরে।”

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ হওয়া কেবল আন্দোলনের অনুঘটক। আসল ক্ষোভ জমে ছিল দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও দীর্ঘদিনের দায়মুক্তির সংস্কৃতি নিয়ে। ২০২৫ সালেই একের পর এক কেলেঙ্কারিতে জনআস্থা ভেঙে পড়েছে—বিমানবন্দর নির্মাণে জালিয়াতি, নেপাল টেলিকমে অর্থ আত্মসাৎ, অভিবাসন দপ্তরে চাঁদাবাজি, সোনা চোরাচালান থেকে শরণার্থী প্রতারণা—সব ক্ষেত্রেই রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ততা ধরা পড়লেও শাস্তি পান কেবল নিচুতলার কর্মীরা।

 

সহিংস বিক্ষোভ ও সেনা মোতায়েন

 

কাঠমান্ডু থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সোমবারে ১৯ জন নিহত হওয়ার পরেও জনগণ কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নামে। সরকারি দপ্তর, সংসদ ভবন, এমনকি পশুপতিনাথ মন্দিরের প্রবেশদ্বার ভাঙচুরের চেষ্টা হয়। আন্দোলনকারীরা প্রেসিডেন্ট ভবন ও বিভিন্ন নেতার ব্যক্তিগত বাড়ি পুড়িয়ে দেয়।

 

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনী কাঠমান্ডু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও প্রশাসনিক ভবন সিংহদরবার দখলে নেয়। সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, “কিছু গোষ্ঠী পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাধারণ নাগরিক ও সরকারি সম্পদের ক্ষতি করছে, তাই শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সব বাহিনী মোতায়েন হবে।”

 

সেনাপ্রধান জেনারেল আশোক রাজ সিগদেল জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেন, “জাতীয় ঐক্য ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” তিনি আলোচনার আহ্বান জানালেও আন্দোলনকারীরা আপাতত দমেনি।

 

জেল ভাঙা ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা

 

সহিংসতার মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় ঘটনা ঘটে জেলগুলোতে। পোখরায় প্রায় ৯০০ বন্দি পালিয়ে যায়, কাঠমান্ডুর নাখু জেল থেকে সব বন্দিকে বের করে আনে আন্দোলনকারীরা। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রবি লামিচ্ছানেকেও সমর্থকেরা মুক্ত করে বাড়ি পৌঁছে দেয়। ধনগড়ি ও তুলসিপুরের জেল থেকেও শত শত বন্দি পালিয়ে গেছে বলে স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত করেছে।

 

গণমাধ্যম, সীমান্ত ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

 

বিক্ষোভকারীরা সংবাদপত্র দ্য কাঠমান্ডু পোস্ট–এর অফিসে আগুন দেয়, সার্ভার বন্ধ হয়ে যায়। সীমান্ত এলাকায় পুলিশ পোস্টে হামলা হয়েছে এবং নেপাল–ভারত সীমান্তের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

 

জাতিসংঘ সব পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজ নাগরিকদের ভ্রমণ এড়াতে বলেছে। প্রায় ২০০ রুশ পর্যটক বর্তমানে নেপালে আছেন, যাদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। চীন এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি, যদিও ওলি ছিলেন বেইজিং–পন্থী হিসেবে পরিচিত।

 

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

 

প্রধানমন্ত্রী ওলির পদত্যাগের পরও অনিশ্চয়তা কাটেনি। কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন শাহ ঘোষণা দিয়েছেন, সংসদ ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনায় বসা হবে না। ফলে সমাধান প্রক্রিয়া আরও জটিল হয়ে উঠছে।

 

এদিকে পুলিশ বিবৃতিতে নিহতদের প্রতি শোক জানিয়ে বলেছে, “ঘটনাটি জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।” সেনাবাহিনী ও পুলিশ যৌথভাবে কঠোর পদক্ষেপ নেবে বলে সতর্ক করেছে।

 

বিদেশি পর্যটক ও সাধারণ মানুষ

 

বিদেশি পর্যটকরা জানিয়েছেন, কাঠমান্ডু কার্যত অচল হয়ে গেছে। এক ব্রিটিশ নাগরিক বলেন, “শহর জ্বলছে, আমরা হোস্টেলে আশ্রয় নিয়ে আছি, বাইরে সেনাদের হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে।” স্থানীয়রা বলছেন, আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ এতটাই গভীর যে তারা শুধু সরকারের পতন নয়, পুরোনো রাজনৈতিক শ্রেণির সম্পূর্ণ অবসান চায়।

 

ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা

 

ওলির পতনের পর নেপালের রাজনীতিতে কে নেতৃত্ব নেবে, তা স্পষ্ট নয়। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণে নিলেও আন্দোলন থামছে না। তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতি, বৈষম্য ও অদক্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নতুন ইতিহাস রচনা করছে—তবে এই ইতিহাস কি হবে গণতান্ত্রিক সংস্কারের, নাকি দীর্ঘ অস্থিরতার, তা সময়ই বলে দেবে।

সব খবর