বিশ্ব উষ্ণায়ন সাধারণত ধ্বংসের প্রতীক—প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের সমার্থক। কিন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তনই এখন নতুন এক ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক বাস্তবতার জন্ম দিচ্ছে। উত্তর মেরুর বরফ গলে যাওয়ায় আবিষ্কৃত হয়েছে ইউরোপমুখী এক বিকল্প সামুদ্রিক রুট, যার নাম “উত্তর সামুদ্রিক রাস্তা” (Northern Sea Route)।
এই নতুন পথ এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক মানচিত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। সর্বাধিক লাভের অবস্থানে রয়েছে চীন—আর এই আবিষ্কারের দিকে গভীর নজর রাখছে ভারতসহ একাধিক দেশ।
চীনের ‘বরফভেদী’ অভিযান
সম্প্রতি একটি চীনা পণ্যবাহী জাহাজ সাফল্যের সঙ্গে মাত্র ছয় দিনে সুমেরু সাগর পেরিয়ে ইউরোপে পৌঁছেছে। এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়ায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।

পথটি শুরু হয় বেরিং প্রণালী থেকে—রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার মাঝে অবস্থিত মাত্র ৮৫ কিলোমিটার চওড়া এক সরু জলপথ। সেখান থেকে বাঁ দিকে মোড় নিয়ে জাহাজটি অতিক্রম করে চুকচি সাগর, পূর্ব সাইবেরিয়া সাগর, ল্যাপতেভ সাগর, কারা সাগর ও ব্যারেন্টস সাগর হয়ে পৌঁছায় নরওয়ে উপকূলে।
এই পথকে ঘিরে চীনা কৌশলবিদদের দাবি, এটি শুধু সময়ই বাঁচাবে না, বরং জ্বালানি খরচ ও পরিবহণ ব্যয়ও কমাবে ৩০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত। কারণ, এখানে নেই শুল্ক, নেই জলদস্যুর ভয়, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাও তুলনামূলকভাবে কম।
‘চোক পয়েন্ট’-এর দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি
চীনের বৈদেশিক বাণিজ্যের মূল ভরকেন্দ্র সমুদ্রপথ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই তাদের কৌশলগত দুর্বলতা হিসেবে ধরা হয় তথাকথিত ‘চোক পয়েন্ট’ বা সংকীর্ণ সামুদ্রিক গলিপথগুলোকে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এর মধ্যে রয়েছে মালাক্কা প্রণালী, যা ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছ দিয়ে গেছে। এই পথ দিয়েই চীনের প্রায় ৭০ শতাংশ অপরিশোধিত তেল আসে। সামান্য সামরিক সংঘাত বা অবরোধই পারে বেইজিংয়ের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিতে।
অন্যদিকে, হরমুজ প্রণালী (ইরান ও ওমানের মাঝে) এবং বাব এল-মান্দেব প্রণালী (ইয়েমেন ও সোমালিয়ার মাঝে)–এই দুই রুটেও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, হুথি বিদ্রোহী হামলা, কিংবা ইরান-মার্কিন দ্বন্দ্ব—সব মিলিয়ে এই রুটগুলো দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

ফলে চীনের কাছে উত্তর সামুদ্রিক পথ এখন এক ‘বিকল্প লাইফলাইন’। মালাক্কা, সুয়েজ বা হরমুজ প্রণালী অচল হলেও, এই রুট দিয়ে বাণিজ্য সচল রাখা সম্ভব।
সুয়েজ ও পানামার বিকল্প
বিশ্বের সবচেয়ে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক রুট সুয়েজ খাল—কিন্তু সেটিরও সীমাবদ্ধতা আছে। কখনও নাব্যতা সমস্যা, কখনও রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়।

অন্যদিকে, পানামা খালের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও মিষ্টি জলের সংকটও এখন চীনের মাথাব্যথার কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনে সেখানে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় ভারী জাহাজ পার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে উত্তর সামুদ্রিক রাস্তা হয়ে উঠছে এক টেকসই ও কম খরচের বিকল্প।
রাশিয়ার উত্তর উপকূল ধরে এই রুট ব্যবহার করে চীন কেবল ইউরোপেই নয়, বরং আর্কটিক অঞ্চলের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের দিকেও হাত বাড়াতে পারবে।
রাশিয়ার ভূমিকা ও কৌশলগত সংবেদনশীলতা
এই নতুন পথের বড় অংশ রাশিয়ার একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। ফলে বাণিজ্যিকভাবে এটি ব্যবহার করতে হলে মস্কোর অনুমতি ও সহযোগিতা অপরিহার্য।

বর্তমানে রাশিয়া-চীন অর্থনৈতিক সহযোগিতায় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া এখন বিপুল পরিমাণে তেল রপ্তানি করছে চীনে আর এই রুট সেই বাণিজ্যকে আরও সস্তা ও কার্যকর করবে।
তবে একটি বড় প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, মস্কো কি বিদেশি জাহাজ চলাচলে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে? কারণ রাশিয়া আর্কটিককে তার কৌশলগত প্রভাবক্ষেত্র হিসেবে দেখে, যেখানে তাদের শক্তিশালী সেনা ঘাঁটি ও পারমাণবিক সাবমেরিন রয়েছে।
আমেরিকার নজর ও সামরিক চ্যালেঞ্জ
বেরিং প্রণালী ঘেঁষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা, যেখানে আছে একাধিক মার্কিন ঘাঁটি। ফলে এই রুটে চীনা জাহাজের আনাগোনা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মার্কিন প্রশাসন হয়তো ভবিষ্যতে এই পথের ওপর নজরদারি বাড়াবে বা কোনও সামরিক চুক্তি প্রয়োগ করতে পারে।
তবুও চীনের কৌশল পরিষ্কার—‘বিকল্প রুট মানেই কৌশলগত স্বাধীনতা’।

বাণিজ্যের পাশাপাশি আর্কটিক অঞ্চলের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ আহরণেও আগ্রহ দেখাচ্ছে বেইজিং। ইতিমধ্যেই তারা নিজেদের ‘আর্কটিক নীতি’ ঘোষণা করেছে, যা পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে একধরনের ‘বরফরাজনীতি’ (Polar Politics)।
ভারতের কৌশলগত লাভের সম্ভাবনা
চীনের মতো ভারতও এই পরিবর্তন থেকে লাভবান হতে পারে। ২০২৩ সালে নয়াদিল্লি চালু করেছে ‘চেন্নাই-ভ্লাদিভস্তক মেরিটাইম করিডোর’, যা প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছায়।
এই রুটের দৈর্ঘ্য সুয়েজ খালের তুলনায় প্রায় ৫,৬০৮ কিলোমিটার কম।

ভ্লাদিভস্তক থেকে বেরিং প্রণালীর দূরত্ব কম হওয়ায়, ভবিষ্যতে ভারতও সহজেই উত্তর সামুদ্রিক পথ ব্যবহার করতে পারবে। এতে সময় ও খরচ দুই-ই বাঁচবে।
তবে সমস্যা একটাই—রাশিয়ার সীমাবদ্ধতা ও মার্কিন কৌশলগত চাপ, যা ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন করে তুলতে পারে।
ভবিষ্যতের বাণিজ্য মানচিত্রে আর্কটিকের ভূমিকা
বিশেষজ্ঞদের মতে, বরফ গলার সঙ্গে সঙ্গে আর্কটিক অঞ্চল আগামী দশকে পরিণত হবে নতুন ‘ইকোনমিক ফ্রন্টিয়ার’-এ।
শুধু নতুন রুট নয়, এখানে রয়েছে তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, নিকেল, লিথিয়ামসহ বিপুল খনিজ সম্পদ। ফলে রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, কানাডা ও নরওয়ের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হবে।

চীন এখন যেভাবে দ্রুত এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে, তা কেবল বাণিজ্য নয়—বরং বৈশ্বিক শক্তির ভারসাম্যকেও নাড়া দেবে। বিশ্ব উষ্ণায়নের ছায়াতেও যে কৌশলগত নতুন যুগের সূচনা হতে পারে—উত্তর সামুদ্রিক রাস্তা তারই জীবন্ত প্রমাণ।
সুমেরুর গলিত বরফ যেমন পরিবেশের জন্য বিপদ, তেমনই বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য এক নতুন সুযোগের প্রতীক। চীনের এই ‘বরফযাত্রা’ এখন শুধু বাণিজ্যের গল্প নয়, বরং ভবিষ্যতের ভূরাজনীতির নতুন অধ্যায়।
বেরিংয়ের বাঁকে যে রাস্তা খুলেছে, সেটাই হয়তো আগামী শতাব্দীর ‘সিল্ক রুট’-এর নতুন রূপ।