পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে টানা পঞ্চম দিন ধরে চলছে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। শুক্রবার (৩ অক্টোবর) পর্যন্ত পরিস্থিতি উত্তপ্তই রয়ে গেছে। সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১৫ জন, আহত হয়েছেন দেড় শতাধিক। নিহতদের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনি পুলিশ সদস্যও রয়েছেন। ক্রমবর্ধমান এই অস্থিরতায় পুরো অঞ্চল কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি, ভর্তুকিযুক্ত আটার সংকট ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকেই আন্দোলনের সূচনা। পরে এটি রূপ নেয় পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এক ব্যাপক গণআন্দোলনে। ২০২৩ সালে প্রথম আন্দোলনের সময় কিছু দাবি মেনে নিয়ে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও, এবার বিক্ষোভকারীরা আরও বিস্তৃত দাবিপত্র সামনে এনেছেন।
জয়েন্ট আওয়ামী অ্যাকশন কমিটি (JAAC)-এর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে দাবি জানানো হয়েছে মোট ৩৮ দফা—যার মধ্যে রয়েছে বিনামূল্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ বিল, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রাজনৈতিক সংস্কার।
এএসি-র শীর্ষ নেতা শওকত নওয়াজ মীর সরাসরি পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীকে তুলনা করেছেন “মানুষ হত্যায় বেপরোয়া এক ডাইনির সঙ্গে”। তার অভিযোগ, ইসলামাবাদ ও রাওয়ালপিন্ডি দশকের পর দশক ধরে কাশ্মীরের মানুষকে দমন করেছে। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সাম্প্রতিক বিতর্কিত মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে মীর বলেন, “যাদের মুখে সবসময় ধর্মের বুলি, তারাই কাশ্মীরিদের রক্তে হাত রাঙিয়েছে।”
তিনি স্পষ্ট বার্তা দেন—“আমাদের সংগ্রাম কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি গোটা দমনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। জনগণের অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত আমরা পিছু হটব না।”
মুজাফফরাবাদ, বাঘ, পুঞ্চসহ বিভিন্ন জেলায় সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১২ জন বেসামরিক নাগরিক। আহত হয়েছেন শতাধিক। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন ৩ পুলিশ সদস্যও। সহিংসতার এই মাত্রা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে অন্যতম ভয়াবহ বলে উল্লেখ করছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম।
সহিংসতা দমনে পাকিস্তান সরকার রাজধানী মুজাফফরাবাদে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে। তারা জেএএসি নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। তবে বৃহস্পতিবারের বৈঠক কোনো সমাধান ছাড়াই শেষ হয়। শুক্রবার আরেক দফা বৈঠকের কথা থাকলেও ক্ষোভ ও অবিশ্বাস এত গভীর যে দ্রুত সমাধান পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এরই মধ্যে কর্তৃপক্ষ মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেনা ও অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে এলাকাজুড়ে। তবে বিক্ষোভকারীরা দাবি তুলেছেন, বাইরের আধাসামরিক বাহিনী না এনে স্থানীয় পুলিশ দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হোক।
কাশ্মীরের জনগণ বলছে, ‘আজাদ কাশ্মীর’ আসলে মুক্ত নয়—বরং পাকিস্তানি শাসনের শৃঙ্খলে বন্দি। দুর্নীতি, অবহেলা, রাজনৈতিক অধিকার হরণ ও অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘদিন জমে থাকা ক্ষোভকে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, কয়েক দশকের মধ্যে এটাই প্রথমবার যখন সরাসরি ইসলামাবাদ ও সেনাবাহিনীকে টার্গেট করছে কাশ্মীরের মানুষ।
সরকার দাবি করছে, দাবিগুলোর বেশিরভাগই পূরণ করা হয়েছে বা প্রক্রিয়াধীন। তবে রাজনৈতিক সংস্কার ও শরণার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বাতিলের মতো ইস্যুতে অচলাবস্থা রয়ে গেছে। আলোচনায় অগ্রগতি না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কাশ্মীর এখন এক অস্থির দ্বিধাবিভক্ত অঞ্চলের প্রতীক—যেখানে মানুষ ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতার দাবি তুলছে, আর পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা তা দমনে ব্যস্ত।