বাংলাদেশে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে গত বছরের জুলাই আন্দোলনের পর থেকে বিভিন্ন হত্যা, চাঁদাবাজি ও ষড়যন্ত্রের মামলায় নিরীহ মানুষ জড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মামলা এখন অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও চাঁদাবাজির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
সাবেক সচিবকেও ছাড় নয়
৭ সেপ্টেম্বর সাবেক সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানকে শাহবাগ থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় আটক দেখানো হয়। যদিও তিনি আলোচ্য অনুষ্ঠানে উপস্থিতই ছিলেন না এবং এজাহারেও তার নাম ছিল না। তার আইনজীবী অভিযোগ করেন, টকশোতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করায় তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। আদালত থেকেও তিনি এখনো জামিন পাননি।
ফুল দিতে গিয়ে রিকশাচালকের কারাগার যাত্রা
১৫ আগস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রিকশাচালক আজিজুর রহমান মারপিটের শিকার হন। কিন্তু হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে পুলিশ তাকে আগের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। পরে আদালত জামিন দিলেও এ ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়। মামলার বাদী শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম পরে জানান, তিনি আসলে নিজের অজান্তেই বাদী হয়ে গেছেন; মামলার নেপথ্যে ছিল স্থানীয় বিএনপি নেতাদের স্বার্থ।
নিহতের পরিবার বাদ দিয়ে বাদী অন্যরা
জুলাই আন্দোলনের সময় নিহতদের পরিবার মামলা না করলেও অনেক ক্ষেত্রে অন্যরা বাদী হয়ে মামলা করেছে। যেমন—উত্তরায় নিহত গাড়িচালক আসাদুল্লাহর পরিবার মামলা করতে না পারলেও তাদের নামে অন্যরা মামলা দায়ের করেছে। নিহতের স্ত্রী ফারজানা বেগম জানান, মামলার অগ্রগতি বা আসামিদের সম্পর্কে তাদের কাছে কোনো তথ্যই নেই।
ব্যবসা দখল ও চাঁদাবাজির অভিযোগ
উত্তরার হকার রুস্তুম আলী জানান, তাকে আওয়ামী লীগের নেতা বানিয়ে হত্যা মামলার আসামি করা হয়েছে, যদিও তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই যুক্ত নন। জামিনে ছাড়া পেলেও তার ব্যবসা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে, যেখানে মাসে এক লাখ টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার সাধারণ মানুষ
কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে যুবদল নেতা রকি ভূঁইয়ার পরিবারও একই অভিজ্ঞতার শিকার। তার অভিযোগ, যেসব ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে অপরাধে জড়িত, তাদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিশোধে নিরীহ লোকজনকে আসামি করা হচ্ছে, নিজ দলের প্রতিপক্ষও বাদ যাচ্ছে না ক্ষেত্রবিশেষে। এমনকি কিছু ঘটনায় মৃত্যুর কারণ ‘হৃদরোগে মৃত্যু’ উল্লেখ থাকলেও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
পুলিশি এজাহারে উদ্দেশ্যমূলক পরিবর্তন
রংপুরের তারাগঞ্জে নিহত রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালের পরিবারের দাবি, পুলিশ এজাহারে ঘটনা পাল্টে দিয়েছে। নিহতদের সঙ্গে থাকা খাবার ও ফলের ব্যাগকে ‘দুর্গন্ধযুক্ত পানীয়’ বলে বর্ণনা করে জনতার হাতে গণপিটুনির কাহিনি বানানো হয়েছে।
মানবাধিকার কর্মীদের সতর্কবার্তা
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, “মিথ্যা মামলা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস এলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই। উল্টো যারা হামলার শিকার, তারাই মামলার আসামি হচ্ছেন। মামলাগুলো এখন চাঁদাবাজির ব্যবসায় রূপ নিয়েছে।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুকের ভাষায়, “আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। ফলে মামলা এখন রাজনৈতিক হয়রানির হাতিয়ার।”
সরকারের অবস্থান
অন্তর্বর্তী সরকার দাবি করছে, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধে তারা আইন সংশোধন করেছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩(ক)/১৭৩(অ) অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত পর্যায়ে নিরীহ আসামিদের অব্যাহতি দিতে পারবেন। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে এভাবে রেহাই দেয়া হয়েছে।
তবে মানবাধিকার সংস্থা ও ভুক্তভোগীদের মতে, মাঠপর্যায়ে পুলিশের হয়রানি বন্ধ না হলে আইনি সংশোধন বাস্তবে কোনো সুফল দেবে না।