দেশে হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, অপহরণ, চুরি, ছিনতাই, দস্যুতা ও ডাকাতি—এই সাত ধরনের অপরাধ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ অপরাধবিষয়ক মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত মাত্র ১৩ মাসে এসব ঘটনায় সারা দেশে ৩৯ হাজার ৯৩৬টি মামলা হয়েছে। গড়ে প্রতি মাসে ৩ হাজার ৭২টি এবং প্রতিদিন ১০২টি মামলা রেকর্ড হয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত একই ধরনের অপরাধে মামলা হয়েছিল ৩৬ হাজার ৩১৫টি। তুলনায় চলতি সময়ে মামলার সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ২১টি।
গত আগস্ট মাসেই দেশের বিভিন্ন থানায় এ ধরনের অপরাধে রেকর্ড হয়েছে ১৫ হাজার ৬৫৬টি মামলা। এর মধ্যে শুধু হত্যা মামলা হয়েছে ৩২১টি, দস্যুতা ও ডাকাতি মামলা ২৩৮টি, নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১ হাজার ৯০৪টি, অপহরণের মামলা ৯০টি, চুরির মামলা ৯৫৬টি এবং পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলার মামলা হয়েছে ৫১টি।
সবচেয়ে বেশি মামলা রেকর্ড হয়েছে ঢাকা মহানগরে। এ সময় ঢাকায় ৩২টি হত্যা, ৫৪টি দস্যুতা ও ডাকাতি, ১৫৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন, ১৬টি অপহরণ ও ১৩২টি চুরির মামলা হয়েছে। চট্টগ্রাম মহানগরে হয়েছে ৩টি হত্যা, ১১টি দস্যুতা, ৪৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন, ৬টি অপহরণ ও ২৫টি চুরির মামলা। খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, গাজীপুর ও রংপুর মহানগরেও একই ধারা লক্ষ্য করা গেছে।
অপরাধবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, হত্যা ও নারী নির্যাতনের মামলাগুলোই সবচেয়ে বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই এসব অপরাধের সঙ্গে মাদকের যোগসূত্র পাওয়া গেছে। তবে অপরাধের তুলনায় প্রতিকার অনেক কম। অনেক আলোচিত মামলাতেও দ্রুত অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। যেমন, রাজধানীর খিলগাঁওয়ে সাংবাদিক রিদওয়ান আক্রামের বাসায় চুরির ঘটনায় এক মাস পার হলেও অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়নি, উদ্ধার হয়নি মালপত্র।
রাজধানী থেকে শুরু করে সাভার, মিরসরাই, ময়মনসিংহ, ঝিনাইদহ, আশুলিয়া এমনকি চট্টগ্রাম পর্যন্ত চাঁদাবাজি ও সহিংসতার ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছে। গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবসায়ী লালচাঁদকে প্রকাশ্যে হত্যা এবং মে মাসে মিরপুরে এক দম্পতিকে খুনের ঘটনা সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
অপরাধ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, শুধু আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে অপরাধ কমানো সম্ভব নয়। তাঁর মতে, মব সহিংসতা ও নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা সমাজে আস্থাহীনতার সংকেত দিচ্ছে। বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সামাজিক অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা ও নৈতিক স্খলনের কারণে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান চালালেও প্রতিহিংসার রাজনীতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধ বাড়িয়ে তুলছে।
ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী জানান, রাজধানীতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে।
গত ছয় মাসে রাজধানীতে সংঘটিত ২১৭টি হত্যাকাণ্ডের বিশ্লেষণ বলছে, বেশির ভাগই রাজনৈতিক কারণে ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রবণতা রোধ না করা গেলে সমাজে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা আরও বাড়তে পারে।