সর্বশেষ

ছোটগল্প

ভুতাং

প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৩০
ভৌতিক কল্পনার ছায়ায় রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও সহিংস বাস্তবতার এক রূপক আখ্যান। ‘ভুতাং’ নামের ভুতের আড়ালে উঠে আসে দেয়াল, রক্ত, স্মৃতি আর লোভের রাজনীতি; যেখানে নিষ্পাপ ভয় ধীরে ধীরে পিশাচে রূপ নেয়। শিশুতোষ ভৌতিকতার ভাষায় গল্পটি বলে যায় আমাদের সময়ের নির্মম সত্য, সাংস্কৃতিক ভয়ের গভীর মনস্তত্ত্ব এবং ক্ষমতার সঙ্গে আপস করা মানুষের পরিণতি।
ভুতাং

চানখাঁর পুল বেলতলা গলির তিন নম্বর বাড়িতে একটা ভুত থাকে। ভুতের নাম ভুতাং। এই নামটা বালামের (নাকি ইর্তেজার!) দেয়া। ভুতেদের তো আর নাম থাকেনা, ভুতেদের থাকে ধরন। এই যেমন ব্রহ্মদত্যি, মামদো, স্কন্ধকাটা, গেছো, মেছো, বেঁশো, নিশি, ফোঁচকে… এমন উনিশ রকমের ভুত নাকি পাওয়া যায় বাংলাদেশে। আর উনত্রিশ কিংবা উনসত্তর হলেই বা কী এসে যায়! এই একটা ভুতেই অভিভূত ওরা। 

 

ওরা, অর্থাৎ বালাম এবং ইর্তেজা দুই যমজ ভাই। দুজন দেখতে অবিকল একরকম। শুধু কি দেখতে! ওদের হাঁটা, চলা, কথা বলা, হাসি, সব কিছুতেই হুবহু মিল। দু’ভাইয়ের জন্য ব্যাপারটা খুব মজার হলেও পাড়ার বন্ধুদের হয়েছে বেজায় মুশকিল। ওরা ধরতেই পারেনা কে যে বালাম আর কে ইর্তেজা। তবে বাচ্চাদের সমস্যা গুলো যেমন মজার, সমধানগুলোও ঠিক তেমন। দু’ভাইয়ের নামদুটোকে ওরা এক সাথে জুড়ে দিয়ে দুজনকেই ডাকে একটা নামে, বালাম ইর্তেজা। সে ডাকে কখনো সাড়া দেয় বালাম, কখনো ইর্তেজা। কে যে আসলে সাড়া দিচ্ছে তা কেউ বলতে পারে না। এমনকি ওদের স্কুলের জাঁদরেল হেডমাস্টার শরীফ স্যারও না।

 

ভুতাং এর কথা দুই’ভাই ছাড়া আর কেউ জানেনা, ওদের বাবা-মাও না। কী করে জানবে? ভুতাং এর গায়ের রং যে নীল! ওদের বসার ঘরের দেয়ালটাও নীল রঙের। সেই নীল দেয়ালের ভৌত কাঠামোয় মিলে মিশে নীলিম হয়ে আছে ভুতাং। এখনও ছোটো বলে ওর ধরনটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা যতই অদ্ভুত শোনাক, একটা বিষয় নিশ্চিত করে বলা যায়- ভুতাং এর ভবিষ্যৎ ভুতুড়েই হবে।

 

ভুতাংকে ওরা পেয়েছিল স্কুলের কলতলায়। টিফিন পিরিয়ডের শেষে গনগনে রোদ্দুরে যখন খাঁ খাঁ করছিল খেলার মাঠ, আর থেকে থেকে বয়ে যাওয়া দমকা হাওয়ায় কুন্ডুলি পাকিয়ে উড়ছিল শুকনো পাতা-বাদামের খোসা-চেটেপুটে ফেলে দেওয়া আচারের ঠোংগা আর হাবিজাবি সব জিনিস, তখন কলতলায় উবু হয়ে বসে আঁজলা ভরে পানি নিতেই ইর্তেজার (নাকি বালামের!) মনে হলো হাতের পানিতে যেন আকাশ নেমে এসছে। এমন ঘন নীল পানির দেখা কেবল সেন্টমার্টিনের সমুদ্রের জলেই মেলে । আর এই গনগনে দুপুরেও পানিটা কী ভীষণ ঠাণ্ডা! যেন রোজার মাসে ঠিক ইফতারির আগে আগে গলির মোড় থেকে কিনে আনা ধানের তুষে জড়ানো পাহাড়ি বরফ। চমকে উঠে হাতের পানি ফেলে দিতেই দ্বিগুণ চমকে গেলো বালাম (কে জানে, হয়তো ইর্তেজাই)। দুহাতের তালুতে জ্বলজ্বল করছে নীল রং। ইর্তেজা, (নাকি বালাম!) কী করবে ভেবে না পেয়ে প্যান্টের পকেটে দু হাত গুঁজে হাঁটতে শুরু করলো ক্লাসের দিকে। এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে ফিরতে, তার উপর শরীফ স্যার যদি ওর নীল রঙে রাঙানো হাত দেখেন তাহলে আর রক্ষা নেই। বালাম ইর্তেজাদের স্কুলের ইউনিফর্ম নীল সাদা। 

 

ক্লাসের দরজায় এসে দাঁড়াতেই শরীফ স্যার বাজখাই গলায় বললেন, 

•      লায়েক হয়ে গিয়েছিস যে বড়! পকেটে হাত দিয়ে হাঁটিস কেন? বের কর হাত। 

ভয়ে ভয়ে পকেট থেকে হাত দুটো বের করে আবারও চমকে উঠলো বালাম (হয়তো ইর্তেজাই)। রঙের কোনো চিহ্নই নেই হাতে! সপাং করে ধেয়ে আসা বেতের বাড়িটা কোনমতে সামলে নিয়ে সে বসে পড়লো বেঞ্চে। ভাইকে ব্যাপারটা বলার জন্য প্রাণ আইঢাই করছে ওর।

 

ক্লাসের শেষে বলবে ভাবলেও বাড়ি ফেরা অবধি বলার সুযোগ মেলেনি আর। এ তো আর সাহেবি স্কুল নয় যে ছোটো ছোটো ক্লাসরুম আর অল্পস্বল্প ছাত্র। চারিদিকে পিলপিল করছে ছেলেদের দল, সবার চোখ এড়িয়ে এমন গোপন একটা কথা কি চুপি চুপি কাউকে বলা যায়! বাড়ি ফিরতেই আবার পড়েছিল মা’র পাল্লায়। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নিজদের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে তাই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে। 

 

ঘটনা শুনে ইর্তেজা (বালামও হতে পারে) বলল,

•      গুল মারার আর জায়গা পাস না, এমন আবার হয় নাকি?

এই নিয়ে দু’ভাইয়ের মধ্যে একটা ঝগড়া হলেও হতে পারতো, কিন্তু তার আগেই কে যেন খোনা গলায় খিক খিক করে হেসে বলল, 

•      হবে না কেন! খুব হয়। 

বালাম ইর্তেজাদের মাথার চুল মিলিটারি আদলে বাটি ছাঁটা করে কাটা না থাকলে খাড়া খাড়া হয়ে যেতো নিশ্চয়ই। দু’ভাইয়ের কোনো একজন ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, 

•      কে? কে কথা বলে? 

•      কে আবার, আমি। এই যে তোমার প্যান্টের পকেটে। এখনও বাইরে আলো আছে বলে দেখতে পাচ্ছ না। আমরা তো অন্ধকার না হলে বের হতে পারি না। এই আর দু’তিন মিনিট। তারপরই দেখতে পাবে। তোমরা আবার ভয় পেওনা যেন। আমার বয়স মাত্র সাড়ে তিন। এখনও ভালো করে দাঁতই উঠেনি। আমি এসেছি তোমাদের সাথে থাকতে। 

 

ভুতাংকে দেখে মোটেই ভয় পায়নি বালাম ইর্তেজা। ওদের খালাতো বোন রুমা’র একটা বিদেশি পুতুল আছে, কী সুন্দর নরম নরম রোম তার, আর একেবারে এইটুকুন, হাতের মুঠোয় এঁটে যায়। ভুতাংও দেখতে তেমনি সুন্দর। রুমা দেখলে বলতোই বলতো,

•      আল্লা এত্ত কিউট! একদম খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

 

তারপর দিন গেল, সপ্তা গেল, বছর বছর সূর্যের চারিদিকে  ঘুরে ঘুরে হন্যে হলো পৃথিবী। 

 

***

 

বালাম ইর্তেজা এখন অনেক বড়। দেখতে তারা এখনও অবিকল একরকম। চানখাঁর পুল বেলতলার তিন নম্বর বাড়িটার আশপাশ জুড়ে অনেকগুলো ফ্ল্যাটবাড়ি দাঁড়িয়ে গেলেও বাড়িটা এখনও তেমনি আছে। আর আছে সেই বেলগাছ, যার নামে গলিটার নাম। এত বড় বেলগাছ সহসা চোখে পড়ে না। দেখলে বিস্ময় জাগে, না জানি এ গাছের শেকড় গিয়েছে কতোটা গভীরে! 

 

বালাম ইর্তেজার বাবা-মা’র বয়স হয়েছে। পুরনো বাড়িতে বড়  শীত শীত লাগে তাঁদের। ছেলে দুটোকে অনেকবার বলেছেন বাড়িটা ভেঙ্গে ফ্ল্যাট বানিয়ে দিতে। জীবনের শেষ কটা দিন যদি একটু আরামে থাকা যায়। কিন্তু বালাম ইর্তেজার কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। প্রসঙ্গটা তুললেই বলে, হাতে টাকা নেই। আচ্ছা বাবা, বাড়ি না হয় না ভাঙলি, নাইবা গড়লি নতুন ফ্ল্যাট, দেয়ালের রঙ গুলোতো পাল্টাতে পারিস তোরা! কিন্তু ওদের ওই একই কথা- টাকা নেই হাতে। শাহাদাত সাহেবের আর ভালো লাগে না।

 

আজ বিকেল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে শহরে। সোফায় বসে খবরের কাগজে চোখ বুলোতে বুলোতে শাহাদাত সাহেব ভাবলেন খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেবেন কিনা। এমন সময় হঠাৎ ঘরটা কেমন যেন দুলে উঠলো। ভূমিকম্প নয়তো! হতেও পারে, অনেকদিন ধরেই তো দুলছে ঢাকা, দুলে চলেছে গোটা দেশটাই। কখনো পাঁচ দশমিক তিন, কখনো চার দশমিক সাত, কোনদিন সাড়ে তিন। যদি সত্যি সত্যি একদিন সাখাওয়াত হোসেনের কথামতো সাত দশমিক ছয় দুই হয়ে যায় তাহলে যে কী হবে এটা ভাবতেই বুক ধুকধুক করে ওঠলো তাঁর। গলা উঁচিয়ে সালেহা বানুকে ডাকতে গিয়ে থমকে গেলেন, অনুভব করলেন ঘরটা আর দুলছে না। সম্ভবত তাঁর মনের ভুল, ঘর ঠিকই আছে, দোদুল্যমান হয়তো তাঁর মনটাই। শুধু শুধু স্ত্রীর ঘুম ভাঙ্গাতে চলেছিলেন। গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আবার ফিরলেন খবরের পাতায়। শীতটা এবার বড্ড বেশি ভোগাচ্ছে। আর দশটা ডিসেম্বরের তুলনায় অনেক বেশি, ভেজা ভেজা একটা ঠাণ্ডা, হাড়ে মাংসে কাঁপন ধরানো শীত। দেয়ালের জায়গায় জায়গায় ছাতা পড়ে গিয়েছে এই ঠাণ্ডায়। এবার রঙটা বদলাতেই হবে। নীল রঙে তো জীবন প্রায় কেটেই গেল, এবার নাহয় সাদা হোক, শরতের আকাশে ভেসে বেড়ানো মেঘের মতো সাদা, তুলোর মতো নরম। শাহাদাত সাহেব গায়ের চাদরটা আরেকবার আঁটোসাঁটো করে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন সোফায়। 

 

দশমিনিট পর, শাহাদাত সাহেব যখন মগ্ন গহন ঘুমের ঘোরে তখন, দেয়াল থেকে হাচরেপাঁচরে পিছলে নেমে এলো ভুতাং। এখন সে আর এইটুকুন নেই, ছোট্ট একটা বাড়ির একরত্তি এক দেয়ালে বিলীন হয়ে থাকতে তার কষ্ট হয় খুব। সারাটা জীবন এমন নীল হয়ে লুকিয়ে থাকার জন্য তো তার জন্ম হয় নি। তার চাই অনেক বড় একটা দেয়াল, দুর্লঙ্ঘ যে দেয়ালের আড়ালে ঢাকা পরে যাবে মধ্যাহ্নের গনগনে সূর্য, চরাচর ঢেকে যাবে নিঃসীম অন্ধকারে, উনিশরকমের ভুতেদের সকসকে নোলায় পিচ্ছিল হয়ে উঠবে পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল। 

 

অনেকক্ষণ ধরেই সালেহা বানুর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। স্বামীকে দশ বারো বার ডেকে ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ টলতে টলতে বসার ঘরে এসে দেখলেন শাহাদাত সাহেব গভীর ঘুমে অচেতন। বড় মায়া হলো তাঁর স্বামীর জন্য। একটা সময় ছিল যখন তিনি এমন সোফায় ঘুমিয়ে যেতেন আর শাহাদাত সাহেব তাঁর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে পড়ে চলতেন বই, ম্যাগাজিন কিংবা খবরের কাগজ। সময় সে বড় হন্তারক। সেদিনের ঝলমলে মানুষটাকে এখন হাজার ডেকেও ঘুম থেকে ওঠানো যায় না। দু’পা এগিয়ে গিয়ে স্বামীর মাথায় হাত রাখতেই আতংকে থরথর করে কেঁপে উঠলেন সালেহা বানু। চকের গুঁড়োর মতো সাদা হয়ে আছে শাহাদাত সাহেবের মুখ। একফোঁটা রক্তের লেশমাত্র নেই সে মুখে। সব রক্ত গিয়ে জমেছে যেন বসবার ঘরের পশ্চিম দিকের দেয়ালটায়। কী ভয়ংকর, কী ভীষণ নির্মম, কী পৈশাচিক একটা লাল দেয়াল! 

 

**** 

 

চানখাঁর পুল বেলতলা গলির তিন নম্বর বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানে পাতাল অবধি শেকড় ছড়ানো বেল গাছটার গা ঘেঁষে বানানো হচ্ছে ভুতাং এর দেয়াল। রাতদিন হন্তদন্ত হয়ে তদারক করে চলেছেন ইর্তেজা (আবার হতে পারেন বালামই)। প্রথম কিস্তি জোগানর পর খরচ নিয়ে আর ভাবতে হয়নি তাঁকে। এখন স্রোতের মতো টাকা আসছে চারিদিক থেকে। একটা কারণে বালামের (নাকি ইর্তেজার!) অল্পস্বল্প মন খারাপ হয় মাঝে মাঝে। মা’কে বোধহয় একটু কম দামেই বিক্রি করা হয়ে গিয়েছে। ভুতাং একটা আস্ত পিশাচ। মা’র রক্ত, মাংস, কিডনি, কলজে, চোখ বাদে শুধু হৃদয়টার দামই তো ছিল সহস্র কোহিনুরের সমান!

 

সব খবর