সর্বশেষ

নোবেলজয়ী ল্যাজলো ক্রাজনাহোরকার গ্রন্থের সমালোচনা

মৃত তিমি, ঈশ্বর অথবা রুশ মাতৃকা: ‘প্রতিরোধের বিষাদ’

প্রকাশিত: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪০
হাঙ্গেরীয় ঔপন্যাসিক ল্যাজলো ক্রাজনাহোরকার ‘প্রতিরোধের বিষাদ (The Melancholy of Resistance)’ নিয়ে মার্কিন লেখক ও সমালোচক এন্ড্রু আরভিন–এর এই নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ফিলাডেলফিয়া সিটি পেপার-এ ২০০১ সালের জানুয়ারিতে। ২০২৫ সালে ক্রাজনাহোরকা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর লেখক তাঁর সেই পুরনো রিভিউটি নতুন করে শেয়ার করেছেন। আমাদের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন অদিতি ফাল্গুনী।
মৃত তিমি, ঈশ্বর অথবা রুশ মাতৃকা: ‘প্রতিরোধের বিষাদ’
২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী হাঙ্গেরীয় ঔপন্যাসিক ল্যাজলো ক্রাজনাহোরকা

আমার বইটিই কি ছিল ল্যাজলো ক্রাজনোহোরকার ‘দ্য মেলাঙ্কলি অফ রেজিস্ট্যান্স’-এর ইংরেজি ভাষায় প্রথম রিভিউ? হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের জন্য আমার প্রেম প্রথম শুরু হয় ১৯৯৪ সালে, যখন আমার কলেজ জীবনের বান্ধবী বুদাপেস্টের লিসজস্ট এ্যাকাডেমিতে সঙ্গীত নিয়ে পড়তে চলে গেলো এবং আমি কয়েক মাস পর ওর পিছু পিছু সেখানে গেলাম। আমরা শুরুতে পরিকল্পনা করেছিলাম মাস নয়েক থাকব বলে, সেই সময়ে বিমানের একটি রিটার্ন টিকিটের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যকালীন সময় পর্যন্ত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছিলাম প্রায় পাঁচ বছর। সেখানে থাকার সময়, আমি দু’টো ইংরেজি পত্রিকায় প্রদায়কের কাজ করতাম এবং অবশেষে সদ্য উদীয়মান ইন্টারনেট ভুবনে কাজ নিই। 

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসার পর, আমি ফিলাডেলফিয়া সিটি পেপার এবং এক পর্যায়ে ‘ইনকোয়্যারার’ এবং ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ’-এর জন্য ফ্রি-ল্যান্সিং শুরু করি। আমার শুরুর দিকের একটি এ্যাসাইনমেন্ট ছিল ল্যাজলো ক্রাজনোহোরকার প্রথম যে উপন্যাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হয়েছিল, সেই ‘দ্য মেলাঙ্কলি অফ রেজিস্ট্যান্স’-এর একটি রিভিউ লেখা। ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ’-এর নগর সংস্করণে সেসময় আমার সম্পাদক নিশ্চিত ভাবেই ছিলেন স্যাম এ্যাডামস, যিনি এখন স্লেট ফেম-এ কাজ করছেন। বইয়ের পাঠ রুচি তাঁর বরাবরই অসাধারণ। আমার লেখা রিভিউটি ২০০১-এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় এবং আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে আমেরিকায় ক্রাজনোহোরকার উপর এটিই প্রথম লেখা কিনা (সম্পাদকের নোট: আমরা এই দাবির বিপরীতে কোন কিছু খুঁজে পাইনি; নিউ ডিরেকশনস এই উপন্যাসের হার্ডকভার সংস্করণ ছেপেছিল ২০০০-এর নভেম্বরে; জেমস উড এর এক দশক পরে ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’-এ এই উপন্যাস নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখবেন এবং সেখান থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রাজনোহোরকার যুগের প্রভাত সূচীত হয়)।

 

আজ সেই লেখক নোবেল পুরষ্কার পাওয়ায় আমার বহু পুরনো রিভিউটি এখানে শেয়ার করে আমি আনন্দিত। বিশ্ব মঞ্চে পুনরায় হাঙ্গেরীয় সাহিত্যকে অভিনন্দিত হতে দেখাটা আনন্দদায়ক, যদিও দেশটির রাজনৈতিক দৃশ্যপটে কাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটছে না। হাঙ্গেরীর মানুষ বিদ্যমান শাসকদের চেয়ে ভাল কিছু পাবার যোগ্য। সে ত’ আমরা সবাই-ই তাই।   

 

আমার সেই বান্ধবী এবং আমি এখন বিবাহিত, এবং এত বছর পরও যখন আমরা বাইরের কারো সামনে নিজেদের ভেতর কী বলছি তা’ বুঝতে দিতে চাই না, তখন হাঙ্গেরীয় ভাষায় কথা বলি। এবার ঘটনাগুলো একটু দ্রুত বলি- ২০১৫ সালে আমি ও আমার বান্ধবীর সাথে ‘ব্রুকলিন বুক ফেস্টিভ্যাল’-এ ক্রাজনোহোরকার আবার দেখা হয়। আমি সেখানে আমার উপন্যাস ‘জর্জ অরওয়েলের গৃহ দাহ (বার্নিং ডাউন জর্জ অরওয়েল’স হাউস)’ যেন একটু বিক্রি-টিক্রি হয় সেজন্য গেছিলাম এবং তিনি ‘নিউ ডিরেকশনস’-এর টেবিলের পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমি তাঁর বই ‘সিওবো দেয়ার বিলো’-র একটি কপি কিনলাম এবং হাঙ্গেরীয়তে তাঁকে বললাম বইটিতে স্বাক্ষর করে দিতে। তিনি খুব ভদ্র ভাবে ইংরেজিতে উত্তর দিলেন এবং স্বাক্ষরে আমার ও আমার স্ত্রীর নাম লিখলেন, যদিও ওর নামটির বানান সঠিক লেখেননি। সে তাতে কিছু মনে করেনি।

 

- এন্ড্রু আরভিন, অক্টোবর ৯, ২০২৫।

 

ইংরেজি ভাষায় অনূদিত ‘দ্য মেলাঙ্কলি অফ রেজিস্ট্যান্স’-এর প্রচ্ছদ 

 

হাঙ্গেরীকে আরো জানুন: ‘প্রতিরোধের বিষাদ’-কে হতে দিন হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের সাথে আপনার প্রথম পরিচয় 

ফিলাডেলফিয়া সিটি পেপার, জানুয়ারি ১৮-২৫, ২০০১ 

 

সাহিত্যের জন্য হাঙ্গেরীর সেই মাত্রার সুনাম নেই যা তার অন্য কিছুর জন্য আছে, যেমন, ধ্রুপদী সঙ্গীত অথবা মদ বা পর্নোগ্রাফির জন্য আছে। কারণ হাঙ্গেরীয়দের মাতৃভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে অনন্য ও অগম্য ভাষাসমূহের একটি। ফিনো-উগরিক ভাষা পরিবারের ক’টি ভাষার নাম আপনি জানেন? ক’জন হাঙ্গেরীয় লেখকের নামই বা শুনেছেন?

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমরা বরং এন্ড্রে এ্যাডি এবং ডেজো কাস্তোলানির চেয়ে বেলা লুগোসি এবং জা জা গ্যাবোরের কাজের সাথে অনেক বেশি পরিচিত। এখন যখন আরো নতুন নতুন ও সাম্প্রতিক হাঙ্গেরীয় লেখকেরা আসছেন, তাঁদের খুব কম সংখ্যকই অনূদিত হয়েছেন এবং আরো কম সংখ্যক লেখক আমাদের এই নতুন পৃথিবীতে কোন পরিচিতি পেয়েছেন। দুই পিটার, নাদাস ও এস্টারহাজি, কয়েক বছর অন্তর ইংরেজিতে নতুন কিছু প্রকাশ করলে ছোট ছোট তরঙ্গ সৃষ্টি হয়, কিন্তু মিক্লোস মেজোলি, লাইয়োস গ্রেন্ডল এবং টাইবর ডেরি অন্তত: আমাদের কাছে এক সত্যিকারের হারিয়ে যাওয়া প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করেন।

 

ল্যাজলো ক্রাজনোহোরকার ‘প্রতিরোধের বিষাদ (দ্য মেলাঙ্কলি অফ রেজিস্ট্যান্স)’ অবশ্য সব কিছু বদলে দিতে পারে। এই হাঙ্গেরীয় বইটি প্রতিটি পাঠ তালিকায় স্থান পেতে পারে এবং প্রতিটি নতুন বছরের সঙ্কল্প-তালিকায় পাঠ্য হিসেবেও ঠাঁই পেতেই পারে।

 

‘প্রতিরোধের বিষাদ’ হাঙ্গেরীতে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে, তবে হাঙ্গেরীর মাগার অঞ্চলের গ্রামীণ পটভূমির মতই এই বইটি সত্যিই এক কালোত্তীর্ন প্রসাদগুণ ধরে রাখে। ক্রাজনোহোরকা প্রেক্ষাপটের বিবরণে মিতব্যয়ী; শুধু কয়েকটি ছোট ছোট সূত্র (ধরা যাক, এক খেলনা সৈন্যের উর্দিতে লাল তারা বসানো, ‘ঐ যত সব চকচকে, উজ্জ্বল মার্সিডিজ’ জাতীয় সংলাপ) দিয়েই তিনি হাঙ্গেরীতে রুশ দখলদারিত্বের লয় পেতে থাকা বছরগুলোয় তাঁর গ্রন্থের কাহিনীকে স্থাপিত করে। অন্যথায় এই কাহিনীকে একশ’ বছর আগে ঘটা কোন ঘটনা হিসেবেও সহজেই ধরা যেত। শ্রেয়তর কোন শব্দের অভাবে এটুকু বলা যাক যে উপন্যাসের ঘটনাক্রম হাঙ্গেরীয়-রোমানীয় সীমান্ত এলাকার একটি ছোট্ট গ্রামে ঘটতে থাকে।

 

বইটি শুরু হয় এই পুরাণকে উড়িয়ে দিয়ে যে আর কিছু না হোক, অন্তত: সোভিয়েতরা রেল গাড়িকে যথাযথ সময়ে চালাতে সক্ষম। সেখান থেকে শুরু করে ক্রাজনোহোরকা সরকারী প্রচারকদের কাছ থেকে সর্বহারার সমষ্টিগত চৈতন্যে প্রবাহিত বহু মিথ্যা প্রচারণাকে ভেঙে ফেলেন। এক ভ্রাম্যমান সার্কাস দল ছোট একটি মফস্বল শহরে এসেছে, যারা গর্ব করছে যে সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিমি মাছটির দেহাবশেষ তাদের কাছে আছে। বিপুলদেহী মৃত পশুটিকে এক শহর থেকে আর এক শহরে টেনে নিয়ে যাওয়াটা যেন এক শুন্য রূপক হিসেবে কাজ করে। লেখক তাঁর আখ্যানকে যথেষ্ট পরিমাণ উন্মুক্ত-পরিসর রেখেছেন যাতে করে যে কোন পাঠক তার নিজ ব্যখ্যা প্রয়োগ করতে পারে। সার্কাসের প্রতি মানুষের আগ্রহ যত বাড়ে, ষড়যন্ত্রও ততই বাড়ে। সার্কাসের অভিনেতাদের কিছু মন্দ অভিপ্রায় আছে বলে স্থানীয়রা মনে করে আর সেজন্যই এই অভিনেতাদের আচরণ এত অদ্ভুত।

 

উইলিয়াম গ্যাডিসের ধ্রুপদী উপন্যাস জেআর-এর মতো, এই বইটিতেও ধারাবর্ণনাকারীর কণ্ঠস্বর ও লক্ষ্যবিন্দু কোন অগ্রিম সঙ্কেত না দিয়েই বদলে যায়, মাঝে মাঝে বাক্যের মাঝখানেই এক চরিত্র থেকে আর এক চরিত্রে সরে সরে যায়। পরাবাস্তববাদের সাথে ক্রাজনাহোরকা যেন প্রেমের ছল করেন, যদিও কখনোই সম্পর্কের পূর্ণতা দেন না। তাঁর লিখনশৈলী ঘনবুনোট, এবং তাঁর আখ্যান বা গল্প সামাজিক পরিবর্তনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে ঘোরে, এবং শুধুমাত্র নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারাই যেন গতিবেগ প্রাপ্ত হয়। প্রতিটি অনুচ্ছেদ ডজন ডজন পাতা ধরে অব্যাহত চলতে থাকে, যেখানে কোন শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ বা কোন উদ্ধৃতকরণ থাকে না।

 

জর্জ সাইরটসের সজীব অনুবাদ ওজনদার, তবে পাঠককে সামনে এগিয়ে যেতে দেবার গতিও বজায় রাখে এবং তাঁর ঐশ্বর্যশালী শব্দ-ভান্ডার ব্যবহারের ঝোঁকের কারণে আপনি বইটি ধীরে ধীরে পড়তে চাইবেন। ভাষা পরিপূর্ণ সাবলীল, যেন তাড়িয়ে তাড়িয়ে চেখে দেখার মত। আখ্যানের ঘূর্ণায়মান গতি তার নিহিতার্থ, রূপক ও ইঙ্গিতে যেন গুলিয়ে ওঠে, যেন বা গোটা কাহিনী বা আখ্যানভাগ সব সেলাই খুলে ফেটে পড়বে। এক ধরণের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা পাঠককে গ্রাস করে। শীতল যুদ্ধের সময়কার সাহিত্য পাঠের একটি কৌতুককর অংশ হলো যে লেখাটি লেখার সময় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির উর্দ্ধেই ইতিহাসের পরিহাসসমূহ উন্মোচিত হতে থাকে। এখন আমাদের রয়েছে এক সম্পূর্ণ পৃথক দৃষ্টিকোণ যেখান থেকে আমরা মুক্ত-পরিসর রূপকগুলোর উপর অর্থ আরোপ করতে পারি। আজ আমরা যা জানি, তা’ যদি ক্রাজনাহোরকা তখন জানতেন, তাহলে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ আলাদা একটি বই হাতে পেতাম। এখন এই বইটি যেমনটা দেখা যাচ্ছে যে খুব-বেশি-দূরের-নয় এমন অতীতের এক নিখুঁত দৃশ্যচিত্র এবং বইটি অবশ্যই সময় ও অনুবাদের দ্বৈত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। মৃত তিমি মাছটি কি ঈশ্বরকে প্রতিনিধিত্ব করছে? মাদার রাশিয়া বা রুশ মাতৃকা? স্বাধীনতা বা মুক্তির জন্য হাঙ্গেরীর বাসনা? প্রত্যেক পাঠককে তাঁর নিজের জন্য অবশ্যই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে।

 

আপনার নিজেকে এবং এক কোটি হাঙ্গেরীয়র একটি উপকার করুন। ল্যাজলো ক্রাজনাহোরকার এই মেধাবী কাজটিকে ঝাপসা ধূসরতায় হারিয়ে যেতে দেবেন না। এই সংবাদপত্রটি নামিয়ে রেখে, বাইরের শীতকে জয় করে এক কপি ‘দ্য মেলাঙ্কলি অফ রেজিস্ট্যান্স’ কিনুন। একটি বিষয়ে কোন ভুল করবেন না: এই বইটি জটিল একটি বই, তবে পড়ার পর দূর্দান্তভাবে পুরষ্কৃত হবেন।

 

নিবন্ধকারের পরিচিতিঃ এন্ড্রু আরভিন দু’টো ফিকশন বইয়ের রচয়িতা: এক্সট্রা-অর্ডিনারি রেন্ডিশনস এবং বার্নিং ডাউন জর্জ অরওয়েল’স হাউস। তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ‘বিট বাই বিট: হাউ ভিডিও গেমস ট্রান্সফর্মড আওয়ার ওয়র্ল্ড।’ তিনি ফিলাডেলফিয়ায় বসবাস করেন।

সব খবর