সর্বশেষ

শচীন দেববর্মণ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ১ নভেম্বর ২০২৫, ১৯:০৬
শচীন দেববর্মণ : শ্রদ্ধাঞ্জলি

১.
 

শচীন দেববর্মণ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী, সুরকার, গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক। বাংলার, বাঙালির, আধুনিক বাংলা গানের রাজপুত্র শচীন দেববর্মণকে উপমহাদেশের সঙ্গীতভূবন চেনে এস.ডি বর্মণ কিংবা শচীনকর্তা নামে। বাংলা ও হিন্দি উভয় ভাষার গানে সমান দক্ষ শচীন দেববর্মণ পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার পাশাপাশি ভারতের হিন্দি বলয়েও তুমুল জনপ্রিয়। বাংলা ও হিন্দির অন্যতম সেরা ও সফল এই সুরকার একশোটিরও বেশি ছবিতে সুরারোপ করেছেন। সুরকার হিসাবে তাঁর প্রথম ছবি ‘রাজগী’। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে শচীন দেববর্মণ জয় করেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার,পদ্মশ্রী,ফিল্মফেয়ার এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি পুরস্কারসহ বহু সম্মাননা। ১৯৭০ ও ১৯৭৪ সালে জাতীয় পুরস্কার, ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মশ্রী’ পেয়েছেন। আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সহযোগিতার জন্য তিনি মুম্বাই, দিল্লি এবং কলকাতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন। তিনি ছিলেন ত্রিপুরার (বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা) চন্দ্রবংশীয় মাণিক্য রাজপরিবারের সন্তান। চাইলেই অনেকটা রাজকীয় জীবন কাটাতে পারতেন। বিলাসে-ভোগে কাটাতে পারতেন দিন। কিন্তু তিনি প্রচলিত পথে হাঁটেননি। রক্তে মিশে থাকা সঙ্গীতের নেশায় কষ্টের পথ বেছে নেন। স্বীয় সঙ্গীত জীবনের বর্ণনা দিয়ে শচীন দেববর্মণ ‘সরগমের নিখাদ’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থও রচনা করেছেন। তাঁর সুর, কণ্ঠ ও সৃষ্টিশীলতা আজও দুই বাংলার,ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে অম্লান।


 

 

২.
 

প্রায় ৬০ একর জমিতে অট্টালিকা, বাগানবাড়ি, সামনে অন্দরমহল, বাড়ির সামনে একটি বড় দিঘি, পেছনে সমান আয়তনের আরও দুটো দিঘি। মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের অর্থানুকূল্যে, কুমিল্লার চর্থায় এই প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন কুমার বাহাদুর নবদ্বীপচন্দ্র। এই প্রাসাদে ১৯০৬ সালের পয়লা অক্টোবর তাঁর ছোট সন্তান শচীন দেববর্মণের জন্ম। সুরকার শচীন দেববর্মণ তাঁর সঙ্গীত জীবনে অসংখ্য গানের সুর করেছেন,যার অধিকাংশ গানই লতা মঙ্গেশকর, মান্না দে, কিশোর কুমার,মো.রফি ও আশা ভোঁসলের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের গাওয়া। তিনি শতাধিক চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও করেছেন। শচীন দেববর্মণের পুত্র রাহুল দেববর্মণও ভারতের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার ছিলেন। তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিণী মীরা দেববর্মণ গীতিকার হিসাবেও সুখ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা গানের কিংবদন্তি গায়ক, অবিস্মরণীয় সঙ্গীত শিল্পী শচীন দেববর্মণের অমর স্মৃতির প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।


৩.
 

শচীন দেববর্মণ- চির অমলিন তাঁর সুর। ‘সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল’- এ শুধু তাঁর গানের পংক্তি নয়, আশ্চর্য বৈভব মণ্ডিত তাঁর সঙ্গীত জীবনের চলার ছন্দ। সুরের নেশায় সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাওয়া শচীন দেববর্মণ বাংলা গানকে দিয়েছিলেন নতুন মাত্রা। কবি নজরুল ইসলাম,কবি জসীমউদ্দীনের কবিতাকে সুরের জীবন দিয়েছিলেন শচীন দেববর্মণ। বাঙালি এখনো মজে আছে সুরের জগতের ‘শচীনকর্তা’র সুরের জাদুতে, মোহন মাধুরীতে। ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ কিংবা ‘শোনো গো দখিন হাওয়া প্রেম করেছি আমি’-এর মতো অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা শচীন দেববর্মণ। শুধু বাংলাদেশ বা ভারতেই নয়, তিনি ও তাঁর গানের জনপ্রিয়তা বিশ্বজোড়া। উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, তাঁর ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সহধর্মিনী মীরা দেববর্মণ ছিলেন আরেক কিংবদন্তি গীতিকার। ১৯৭১ সালে মীরা দেববর্মণের লেখা ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই’ গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের বুকে জাগিয়েছে মুক্তির প্রণোদনা।
 

৪.
 

তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ত্রিপুরা (বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলা) রাজ্যের রাজ পরিবারে জন্মেছিলেন এই শতাব্দীর সঙ্গীত ভুবনের বিস্ময় ব্যক্তিত্ব কুমার শচীন দেববর্মণ। সঙ্গীত সমঝদার পরিবার হিসেবেও খ্যাতি ছিলো এই রাজ পরিবারের। শচীন দেববর্মণের পিতা সুগায়ক নবদ্বীপচন্দ্র দেব বাহাদুর ছিলেন ত্রিপুরা রাজবংশের সন্তান। পিতা নবদ্বীপচন্দ্র ছিলেন নিপুণ সেতার শিল্পীও। ধ্রুপদ সঙ্গীত,সেতার বাজানো আর ভাস্কর্য তৈরিকেই ধ্যানজ্ঞান মানতেন শচীন দেববর্মণের প্রথম সঙ্গীতগুরু তাঁর পিতা নবদ্বীপচন্দ্র। আর তাঁর মা ছিলেন মণিপুরি রাজবংশের মেয়ে নিরুপমা দেবী। পিতৃমাতৃকুলের ঋদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য শচীন দেবকে ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতে বিপুলভাবে টেনেছিল। মার্গ সঙ্গীতের প্রথম গুরু তাঁর বাবা। আগরতলার বাসিন্দা হলেও শচীন দেবের শৈশব কেটেছে কুমিল্লায় এবং শেষ জীবন ভারতের মুম্বাইতে। তাঁর সহধর্মিণী মীরা দেবী এবং একমাত্র পুত্র রাহুল দেববর্মণও মুম্বাই চিত্রজগতের প্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী ছিলেন।
 

৫.
 

স্কুলের পড়ার সময়েই কিশোর শচীনের সঙ্গীত প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তবে ছেলে শচীন যে এমন জগদ্বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ হবেন তা তাঁর বাবা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তাঁর প্রবল আগ্রহকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে তখনকার কুমিল্লার গুণী উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী শ্যামাচরণ দত্তকে ছেলের শিক্ষক নির্বাচিত করেন। কিন্তু শচীনের আগ্রহ উদাস বাঁশির সুর মাঝি-মাল্লা আর ফকির-বোষ্টমীদের গান। কৈশোরে তাই তিনি বাউল, ভাটিয়ালি আর পল্লীগীতির মোহজালে বাঁধা পড়েছিলেন। 
 

৬.
 

বাংলা গানকে উচ্চতায় নিতে কলকাতা তাঁর জীবনের মূল ভিত্তি রচনা করে দেয়। কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গানই ছিল শচীন কর্তার জীবনের মানে। বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরেই সংগীতের শীর্ষস্থান দখল করেন হিন্দি জনপ্রিয় সব সিনেমার জন্য গান করে, গান সুর করে, সংগীত পরিচালনা করে। এই মহান মানুষটি যদিও শৈশবে আগরতলা শহরের একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে ভর্তি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তিনি পরে ভর্তি হন কুমিল্লা শহরের ইউসুফ স্কুলে। তারপর পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন কুমিল্লা জিলা স্কুলে। ১৯২০ সালে জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৪ বছর বয়সে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে (বর্তমানে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া গভর্নমেন্ট কলেজ) ভর্তি হন। ১৯২২ সালে এ কলেজ থেকে আই.এ ও ১৯২৪ সালে বি.এ পাস করেন।

 


৭.
 

তৎকালীন ত্রিপুরার (বর্তমান কুমিল্লা) ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা এলেন ১৯২৫ সালে। প্রবল ইচ্ছে ছিল নামকরা হিন্দুস্তানি ওস্তাদের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার। সেখানেই মূলত তাঁর আসল সঙ্গীত জীবন শুরু হয়। এর আগেই পূর্ব বাংলার রাখাল ছেলে, নৌকার মাঝি-মাল্লা, মাঠের কৃষক এদের কাছ থেকে পেয়েছেন বাংলার লোকসঙ্গীতের হৃদয় উৎসারিত সুরের সঞ্জীবনী সুধা। সুরের নেশায় রাজপুত্র হয়েও মিশেছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে এবং সেখান থেকেই আহরণ করেছেন বাংলার লোকগানের মাধুরিমা। যার ছোঁয়া দেখতে পাই আমরা তাঁর সুরারোপিত প্রতিটি গানে।


৮.
 

কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এসে শচীন দেববর্মণের আরম্ভ হল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে ত্রিপুরা ভবনে নূতন জীবন। তিনি কৃষ্ণচন্দ্র দের সঙ্গে সঙ্গে জলসায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন কি কখনো কখনো তাঁর সঙ্গে চলে যাচ্ছেন বাঁইজী বাড়িতে গান শুনতে। কেষ্ট বাবুর অনুমতি নিয়ে গান শিখতে গেলেন সে কালের প্রবীণ ওস্তাদ বাদল খাঁর কাছে। যাঁর কাছে গান শিখেছেন কৃষ্ণচন্দ্র দে নিজেও। তবে কৃষ্ণচন্দ্র দে, যে দৃষ্টিহীন মানুষটির কাছে বাংলা এবং ভারতের সঙ্গীত নানা কারণে চিরকাল ঋণী থাকবেন, সেই সব কারণের মধ্যে একটি অবশ্যই থাকবে তরুণ শচীন দেববর্মণকে সঙ্গীতের সঠিক রাস্তাটিকে চিনিয়ে দেবার জন্যে।


৯.
 

শচীন দেববর্মণ শৈশব থেকেই লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বহু লোকসঙ্গীত সংগ্রহ করেন এবং রাগসঙ্গীতের সংমিশ্রণে সুরারোপ করে নতুন সুরজাল সৃষ্টি করেন। রাগসঙ্গীতে তাঁর ভাল দখল ছিল। কুমিল্লার বিখ্যাত গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুরসাগর হিমাংশু দত্তের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়াত আলী খাঁ, ওস্তাদ জানে আলম চৌধুরী (জানু মিয়া),ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু তখন সঙ্গীত জগতের দিকপাল ছিলেন বলে তখন তাদের সঙ্গে শচীন দেববর্মণের সখ্য গড়ে ওঠে। কলকাতায় তিনি পাগলের মত গান শুনে বেড়াতেন নানা আসরে। এই সব আসরে গিয়ে আলাপ হয়েছিল বিশাল সব সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীত রসিকদের সঙ্গে।


১০.
 

শচীন দেবের বয়স যখন পঁচিশ তখন তাঁর বাবা কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর পিতা নবদ্বীপচন্দ্র ১৯৩১ সালে কলকাতায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন ত্রিপুরার প্রধানমন্ত্রী। শচীন দেববর্মণ তখন থাকতেন কলকাতার ত্রিপুরা প্যালেসে। পিতার মৃত্যুর পরে শচীন দেবের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া। শচীন দেববর্মণ ১৯২৩ সালে কলকাতা বেতারে প্রথম গান করেন এবং ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড বের হয়। হিন্দুস্তান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস থেকে তাঁর দুটি রেকর্ড বের হয়। গান দুটি ছিল পল্লীগীতির ঢঙে গাওয়া ‘ডাকিলে কোকিল রোজ বিহানে’ এবং খাম্বাজ ঠুমরি অঙ্গের রাগপ্রধান ‘এ পথে আজ এসো প্রিয়’। এরপর থেকে তাঁর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। কলকাতাই তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিল সৃষ্টিলোকের চাবিকাঠি। কলকাতায় All India Radio হবার আগে তার নাম ছিল Indian State Broadcasting Co. এই কোম্পানির কর্তাব্যক্তি ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল, নৃপেন মজুমদার। ওঁরা তরুণ শচীনদেবকে সুযোগ দিলেন তাঁর নিজের সুরে দু’খানি গান রেডিওতে গাইবার। বিনিময়ে দশ টাকা পারিশ্রমিক। সুরকার শচীন দেববর্মণের যাত্রা এভাবেই শুরু হল। এরপর এই হিন্দুস্থান রেকর্ডস থেকে তিনি সব মিলিয়ে ১৩২টি বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। এই সব গানের গীতিকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হেমেন্দ্র কুমার রায়, শৈলেন রায়, অজয় ভট্টাচার্য, জসীমউদ্দীন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রবি গুহ মজুমদার, সুবোধ পুরকায়স্থ, মোহিনী চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এবং মীরা দেববর্মণ। তাঁর বহুসংখ্যক বাংলা ও হিন্দি গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়।


১১.
 

শচীন দেববর্মণ ১৯২৫ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার পর ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বসবাস করেন। এরপর তিনি মুম্বাই (বোম্বে) চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। ১৯৪৪ সালে তিনি সপরিবারে মুম্বাই গিয়ে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের মর্যাদা লাভ করেন। শচীন দেববর্মণ অনেক বাংলা গানে সুর দিয়েছেন। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা মৌলিক গানে তিনি এই সময়ে হয়ে উঠেছিলেন এক নম্বর শিল্পী। মৌলিক গানের সুরকার হিসেবেও তিনি অসাধারণ কাজ করেন রাগ সঙ্গীতের সঙ্গে লোক গানের মিশ্রণ ঘটিয়ে। তা হলেও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের ওস্তাদরা তাঁর গানে মুগ্ধ ছিলেন। ১৯৩৪ সালে অল ইন্ডিয়ান মিউজিক কনফারেন্সে তিনি গান গেয়ে ওস্তাদ করিম খাঁর আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। স্বর্ণপদকও লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে ঠুমরি পেশ করে ‘আফতাব এ মৌসকী’ ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেছিলেন। অন্যদিকে শেখ ভানুর রচনা ‘নিশীথে যাইয়ো ফুলবনে’ দেহ ও সাধনতত্ত্বের গানটিকে প্রেমের গানে রূপান্তর করলেন মরমী কবি জসীমউদ্দীনকে দিয়ে এবং রূপান্তরিত এই গানটি রেকর্ড করলেন ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৭ সাল থেকে পরপর কয়েকটি বাংলা ছায়াছবিতে তিনি সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছায়াছবি হলো: রাজগী, ছদ্মবেশী, জীবন-সঙ্গিনী, মাটির ঘর ইত্যাদি। রাগপ্রধান বাংলা গানে এভাবেই শচীন দেববর্মণের অবিস্মরণীয় অবদান রাখতে থাকেন। তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত সাধনার সুখ্যাতি এ উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।


১২.
 

কণ্ঠশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেববর্মণ (জন্ম : ০১ অক্টোবর ১৯০৬ – প্রয়াণ : ৩১ অক্টোবর, ১৯৭৫) শুধু অসামান্য গায়ক এবং সুরকারই ছিলেন না, তিনি তৎকালীন কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল দলের একজন ফুটবল খেলোয়াড়ও ছিলেন এবং খুবই সুন্দর তবলা ও বাঁশি বাজাতেন, একজন বিশিষ্ট ক্রীড়ামোদীও ছিলেন। শচীন দেববর্মণ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চ পদ অলঙ্কৃত করেন এবং বহু সংগঠন কর্তৃক সম্মানিত হন। ১৯৫৮ সালে সঙ্গীত-নাটক আকাদেমি ও এশিয়ান ফিল্ম সোসাইটি (লন্ডন) এবং ১৯৬৩ সালে ত্রিপুরা ললিতকলা কেন্দ্র তাঁকে অভিনন্দিত করে। আগেও উল্লেখ করেছি, ১৯৬৯ সালে তিনি ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন এবং ‘আরাধনা’ হিন্দি ছবিতে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য গায়ক হিসেবে তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। অনেক সাংস্কৃতিক দলের বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে তিনি ব্রিটেন, রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেন। কলকাতায় অবস্থানকালে শচীন দেববর্মণ গণনাট্য সঙ্ঘের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছিলেন। তিনি গণনাট্য সঙ্ঘের বাংলা লোকসঙ্গীত শাখার সভাপতি ছিলেন। শচীন দেববর্মণ লিখেছেন,‘…আই.পি.টি,এ-এর সঙ্গে জড়িত থাকাকালে বুঝতে পারলাম ভারতবর্ষের লোকসঙ্গীত কত বিচিত্র ও বৃহৎ সংগীত সম্পদে পুষ্ট।’ সঙ্গীতে তাঁর অসামান্য অবদান উপমহাদেশের শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আবারো সশ্রদ্ধ প্রণাম সঙ্গীতের রাজকুমার শচীন দেববর্মণকে। শচীনকর্তাকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ভালোবাসা জানাই।

 

মহুয়া মোহাম্মদ
গণমাধ্যমকর্মী
৩১ অক্টোবর ২০২৫

সব খবর