সর্বশেষ

সলীল চৌধুরী জন্মশতবর্ষ

স্মৃতির গভীরে যে সুর আজো বাজে

প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৩:৪৩
বাংলা গান, গণসঙ্গীত ও চলচ্চিত্রের সুরমণ্ডলে সলীল চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। জন্মশতবর্ষে তাঁকে স্মরণ করতে গিয়ে রহমান লেনিন ফিরে দেখেছেন সেই সুরকারের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক চেতনা এবং কালজয়ী সুরমাধুর্য, যার ভেতর দিয়ে দুই বাংলার মানুষের আবেগ ও স্মৃতি আজও সমানভাবে আলোড়িত হয়। এই নিবন্ধে উঠে এসেছে সলীলের গানকে ঘিরে ব্যক্তিগত স্মৃতি, সাংস্কৃতিক মানসশাস্ত্র এবং তাঁর সৃষ্টির অমলিন মানবিকতা।
স্মৃতির গভীরে যে সুর আজো বাজে

সময় যত দ্রুতই বদলায়, আমার ভেতরের এক কোনায় ‘সলীল চৌধুরী’ ঠিক একই রকম থেকে যান। তাঁর জন্মশতবর্ষের এই মুহূর্তে ফিরে তাকালে স্পষ্ট হয় সলীল চৌধুরী’র সঙ্গীত আসলে ‘সময়ের ওপরে দাঁড়ানো শিল্প। তাঁর গান আসলে কোনো নির্দিষ্ট প্রজন্মের নয়; এটি এক চলমান সাংস্কৃতিক ভাষা,যা দুই বাংলার মানুষের স্মৃতি, আবেগ ও চিন্তাকে সমানভাবে ছুঁয়ে থাকে।


অনেকের মতোই আমাদের শৈশব–কৈশোরের স্মৃতি জুড়ে আছে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতে থাকা তাঁর গান-যা শুনলেই ফিরে যেতে হয় হারানো দিনগুলোর দিকে, এক অদ্ভুত আবেগমথিত আলোড়নে! 
 

আমার শৈশব–কৈশোরের স্মৃতিতে আজও রয়ে গেছে দুপুরে নির্জন ঘরে সেই  ক্যাসেট প্লেয়ারের শব্দ-‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’,এই গান আমাকে অদ্ভুত এক অনিশ্চিত ভাবনায় ফেলত! সন্ধ্যায় বন্ধুদের আড্ডায় হঠাৎ ‘যারে যারে উড়ে  যারে পাখি’ কণ্ঠে সুর উঠলে মনে হতো, নদীর মতো আমরাও কোথাও মুক্তির দিকে ভেসে যাচ্ছি। আজো অজান্তে গুনগুন করে উঠি, যেন সত্তার গভীর কোথাও তাঁর সুর চিরস্থায়ী হয়ে আছে। 
 

 

সলীলে’র গান আমাদের জন্য কখনোই শুধু গান নয়;এ ছিল পৃথিবী দেখার এক নতুন জানালা। তাঁর ভৌগোলিক স্বপ্নদর্শন-অসমের মেঘলা চা বাগান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নদী, কলকাতার শহুরে ঘূর্ণি,পাশ্চাত্যের সিম্ফনির সুর সব মিলিয়ে আমাদের শিখিয়েছে সঙ্গীতকে এক অনন্ত ভুবন হিসেবে চিনতে।


সলীল চৌধুরী গানকে কখনোই বিনোদন হিসেবে দেখেননি; তিনি দেখেছেন সামাজিক বয়ান হিসেবে। ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানে সলিল অন্ধকার সমাজব্যবস্থা  ভেদ করে মুক্তি, ন্যায় ও মানবমুক্তির আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই গান কেবল রাজনৈতিক নয়; যেন মানবমুক্তির কবিতা।   
 

‘যারে যা উড়ে যা’, এই গানে নদী ও মানুষের মুক্তির যে দার্শনিক সুর, তারই বিপরীতে ‘ধিতাং ধিতাং বলে’, এই গানের ছন্দ এক শহুরে উদ্দামতাকে সামনে আনে। পরোক্ষে সামন্তবাদ, লোভ, ক্ষমতালোভীদের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক প্রকাশ। আবার ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, এই গান মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্বকে নতুন ভাষা দিয়েছে ; একই সাথে মানব–সংকটের শাশ্বত প্রশ্নকে ছুঁয়ে যায়।

 


গণসঙ্গীতের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বয়ান থেকে চলচ্চিত্রের প্রেম–বেদনার বিস্তৃত আবেগ সবক্ষেত্রে তিনি দেখিয়েছেন গানের সুর একদিকে প্রতিবাদ, অন্যদিকে মানবিক আর্তির পথ। চলচ্চিত্রে তৈরি করেছেন ‘কেন কিছু কথা বলো না’ গান যেন নিভৃত প্রেমের তরঙ্গ। শিল্প তাঁর কাছে ছিল জীবনের রূপ, সংগ্রাম, প্রেম, স্বপ্ন, প্রতিবাদ সব মিলিয়ে।
 

সলীল চৌধুরী দুই বাংলার মানুষের কাছে চিরন্তন। কারণ শুধু তাঁর সুরের কৌশল নয়; এর পিছনে আছে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতি, যৌথ সংগ্রাম এবং নস্ট্যালজিয়ার গভীর অনুভব। কারণ, তাঁর প্রতিটি গান যেন আলাদা পৃথিবীর আলাদা দরজা! শৈশব- কৈশোরের ‘আমি’ সেই দরজাগুলো খুলে বিস্মিত হয়ে যেতাম, এখনো হই!  
 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়- এর কণ্ঠে যখন ভেসে আসে ‘শোনো কোনো একদিন’, সলিল গানটিকে এমনভাবে লিখেছেন যাতে মনে হয় কেউ আপনজনকে ভবিষ্যতের কোনো সময়ের জন্য একটি নীরব বার্তা রেখে যাচ্ছে। যেন হেমন্তে’র মায়াবী কণ্ঠে সলীল বলছেন-‘মানুষের প্রতি মানুষের মায়াই শেষ আশ্রয়’। এটি যেন স্মৃতি থেকে উঠে আসা মানুষের আত্মস্বীকারোক্তি।

 

তিনি সময়ের গান করেননি; মানুষের গান করেছেন। তাঁর সৃষ্টি সামাজিক, ব্যক্তিগত, দার্শনিক এবং নান্দনিক সব স্তরে কাজ করে। তাঁর গান আগামী প্রজন্মের কাছেও সমান অর্থবহ হবে। কারণ, এগুলো মানুষের অস্তিত্বের মৌলিক অভিজ্ঞতাকে ধরেছে।
 

 

আজকের তরুণ শিল্পীরা যেভাবে ‘জেন জি’ সংস্কৃতির দুঃসাহস নিয়ে সাউন্ডের দেয়াল ভেঙে দিচ্ছে, সেই একই পরীক্ষামূলক মনোভাব তিনি বহন করেছেন বহু আগেই। তাই তাঁর গান পুনর্বার নতুন করে কম্পোজ করলেও মনে হবে এ তো একেবারে আজকের সুর।
 

তাঁর জন্মশতবর্ষে ফিরে দেখা যায়-সলীল চৌধুরী বাংলা গানের শুধু একজন সুরকার, গীতিকার এবং সংগীত পরিচালক নন; তিনি এক সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ, যিনি দুই বাংলার অনুভূতিকে একই সুতোয় গেঁথেছেন। জন্মশতবর্ষে তাঁর গান নতুন করে মনে করিয়ে দেয়-অসাধারণ সৃষ্টির কোনো সময়সীমা নেই; সুর যদি মানুষের ভেতরের সত্যকে ছুঁতে পারে, তবে তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকে।


যখন সলীল চৌধুরী’র কথা ও সুরে শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে শুনি ‘যদি কিছু আমারে সুধাও’, মনে হয়-সলীল চৌধুরী সরাসরি আমাদের সঙ্গে কথা বলছেন। প্রতিটি স্বরে, প্রতিটি সুরে যেন বলা হচ্ছে-‘মানুষের প্রতি মানুষের মায়া, মানুষের প্রতি মানুষের দায়িত্বই চিরন্তন’। সুরের ভিতরে লুকানো সেই মানবিক সত্য আজও আমাদের সঙ্গে বেঁচে আছে, বাঁচবে আগামী প্রজন্মেও।


সলীল চৌধুরীর গান আমাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি, আমাদের সামাজিক ইতিহাস, আমাদের ভাষাবোধ সবকিছুকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আর সেই কারণেই আজও অজান্তে গুনগুন করে উঠি তাঁর কোন সুর। যেন আমার ভেতরের এক অংশ তাঁর গানেই গড়ে উঠেছে।

সব খবর