হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। শনিবার দুপুর ২টার দিকে শুরু হওয়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে প্রায় সাত ঘণ্টা পর। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট টানা অভিযান চালিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান জানান, প্রতিদিন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ কারখানার পণ্য বিমানপথে রপ্তানি হয়। “এই হিসেবে আমরা আশঙ্কা করছি, অন্তত ২৫০টি কারখানা এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে,” বলেন তিনি। বিজিএমইএ ইতিমধ্যে সদস্যদের ক্ষতির তালিকা জমা দিতে বলেছে।
একইভাবে সবজি ও পচনশীল পণ্য রপ্তানিকারক সমিতি (বিএফভিএপিইএ)-এর সভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বিমান চলাচল বন্ধ থাকলে রপ্তানিতে বড় ধাক্কা লাগবে। “আমাদের পাইপলাইনে থাকা পণ্য দ্রুত পাঠানো না গেলে তা নষ্ট হয়ে যাবে,” বলেন তিনি।
অবহেলায় ভয়াবহতা, প্রশ্ন নিরাপত্তা নিয়ে
রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় এভাবে আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নিরাপত্তা ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাপনা নিয়ে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছিল, যুক্তরাজ্যের ডিপার্টমেন্ট ফর ট্রান্সপোর্ট (ডিএফটি) শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো শাখাকে ‘শতভাগ নিরাপদ’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের অভিযোগ, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি করেছে। বিমানবন্দরের নিজস্ব ফায়ার ইউনিটও প্রথমে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। বেবিচকের অধীনে থাকা অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপন গাড়িগুলো দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়ায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করেন তারা।
এ ওয়ান লজিস্টিক কোম্পানির পরিচালক ইমরান হোসাইন বলেন, “আগুন কুরিয়ার গুদাম থেকে শুরু হয়েছিল। আমরা নেভাতে গেলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, বলা হয় ভিতরে কেমিকেল আছে।”
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল জানিয়েছেন, দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে তারা খবর পান এবং ২টা ৫০ মিনিটে প্রথম ইউনিট পৌঁছায়। তিনি বলেন, “বাতাসের তীব্রতার কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমাদেরকে সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে, কারণ কিছু কেমিকেল থাকতেও পারে।”
ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুশ্চিন্তা
ক্ষতির পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা না গেলেও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা দাবি করছেন, ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। ফাস্ট অ্যান্ড সেইফ লজিস্টিকসের কর্মকর্তা আব্দুল মোমিন মণ্ডল বলেন, “আমাদের চামড়া, কাপড়, সুতা সবই পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিস আসার আগেই আগুন অনেক ছড়িয়ে পড়ে।”
অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলারের অধীনে থাকা পণ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে তারা চার্জ দিয়ে থাকেন। এখন সেই পণ্য পুড়ে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ কে দেবে তা স্পষ্ট নয়। এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, “আমার বীমা আছে ঠিকই, কিন্তু তা মাত্র ৬ হাজার ডলার পর্যন্ত কভার করে। অথচ ক্ষতি শত কোটি টাকার।”
বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, “আমরা ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ করছি। বিমানের কার্গো পরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ম্যানিফেস্ট অনুযায়ী একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করতে।”
তদন্ত ও নাশকতার প্রশ্ন
সরকারি উদ্যোগে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। একটি বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় এবং অন্যটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে।
ঘটনাটি নাশকতা না দুর্ঘটনা তা নিয়েও চলছে জল্পনা। বিএনপির পক্ষ থেকেও পূর্বপরিকল্পিত কি না তা তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “নাশকতার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলোতে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তবে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সবগুলো ঘটনার গভীর তদন্ত করছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল উপদেষ্টা বশিরউদ্দীন সাংবাদিকদের বলেন, “এখন সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে বিমানবন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালু করা ও ক্ষতি নিরূপণ করা। নাশকতা না দুর্ঘটনা, সেটা তদন্তেই প্রমাণিত হবে।”