গত ৯ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল, স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করলে আন্তর্জাতিকভাবে ভুল বার্তা যাবে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। তবে আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, নিরাপদ আবাসনসহ সকল মানবিক প্রয়োজন পূরণ করা হয়েছে।
কিন্তু ঠিক সেই জায়গাতেই প্রশ্ন উঠছে, যে নীতি গত এক দশক ধরে কঠোরভাবে অনুসৃত হয়েছিল, সেই নীতির ব্যতিক্রম ঘটল এখন কেন? বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন রাষ্ট্র পরিচালনায় রয়েছে একটি অন্তর্বর্তী সরকার, যার সাংবিধানিক মেয়াদ সীমিত এবং যার রাজনৈতিক ম্যান্ডেট দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার নয়।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি আইওএমের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের অনুমতি পেয়েছে। ‘হেল্প’ প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজারে দুর্যোগ সহনশীল স্থাপনা, প্রবেশাধিকার এবং নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৬৩ কোটি টাকা।
অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্যই আরও প্রশ্ন তৈরি করেছে। তিনি বলেন, “ওরা ফোর্সডলি ডিসপ্লেসড রোহিঙ্গা, যথাশীঘ্রই আমরা পাঠাব। কিন্তু যে সময়টা আছে, মানবেতর জীবন যাপন করা কাম্য নয়।”
কিন্তু প্রশ্ন হলো যদি সত্যিই রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোই লক্ষ্য হয়, তাহলে কেন স্থাপনা নির্মাণে এত বড় বিনিয়োগ? স্থায়ী অবকাঠামো কি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে অন্তর্বর্তী সরকার স্বীকার করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশেই থেকে যাবে?
যেখানে পূর্ববর্তী সরকার প্রত্যাবাসনকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক চাপও প্রতিহত করেছে, সেখানে এখন এই অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে কী যুক্তি? এটি কি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ, নাকি প্রশাসনিক কাঠামোর ভিন্ন অগ্রাধিকার? আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক বৈধতা কতটা?
রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা, অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করছে। স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবে কি তাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাসের পথ প্রশস্ত করবে? তাহলে কি এটি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার উপর একটি নীরব স্বীকারোক্তি যে রোহিঙ্গারা আর দেশে ফিরবে না?
মানবিক দায়বদ্ধতা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তা, সীমান্তনীতি ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত সিদ্ধান্তের প্রশ্নে এই নীতিগত অনুমোদন অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধ ম্যান্ডেটকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে কি না সেই প্রশ্ন এখন রাষ্ট্রীয় পরিসরে বড় করে উঠছে।
এই সিদ্ধান্ত প্রশাসনিক প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক চাহিদা নাকি রাজনৈতিক দুর্বলতার ফল তা জানার অপেক্ষায় দেশ।