মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৭ ডিসেম্বর দিনটি রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক-সব ক্ষেত্রেই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বেতার ভাষণে ঘোষণা দেন ঢাকা মুক্ত হতে আর বেশি দেরি নেই। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন দিবালোকের মতোই সত্য। বঙ্গবন্ধুও শিগগির দেশের মাটিতে ফিরে আসবেন।”
জাতিসংঘে উত্তেজনা, সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো
৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে আর্জেন্টিনার প্রস্তাব তোলা হয়, যেখানে ভারত–পাকিস্তান বিরোধ শান্ত করতে দুই পক্ষকেই সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটির সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবটিতে ভেটো দেয়। ফলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের পক্ষে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
এদিন মুজিবনগর সরকারের মুখপাত্র জানান, ভারতের স্বীকৃতির পর মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে—ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সরকারের দপ্তর ঢাকায় স্থানান্তর করা হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
রেডিও আকাশবাণী থেকে রাত ১০টায় ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানি সেনাদের পিছু হটার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে, আত্মসমর্পণই একমাত্র বিকল্প।
সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভও বিবৃতিতে বলেন, যুদ্ধ কেবল প্রাণহানি বাড়াচ্ছে; শান্তিপূর্ণ আলোচনা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়। অন্যদিকে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেওয়া অর্থনৈতিক সহায়তা বাতিল করেছে।
দেশব্যাপী বিজয়ের অগ্রযাত্রা
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এদিন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত জয়ের দিকে এগিয়ে যায়। কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধারা বিবির বাজার, ভাটপাড়া ও বাঘেরচর দিয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ চালালে হানাদার বাহিনী বিমানবন্দর ছেড়ে পালায়।
সিলেটে, মেজর শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে ৩য় বেংগলের দুটি কোম্পানি এবং ভারতীয় ছত্রীসেনা বিমানবন্দর দখলে নেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুরে তীব্র সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটে।
ময়মনসিংহের ভালুকায়, আফসার বাহিনীর আক্রমণে হানাদাররা থানার অবস্থান ছেড়ে পালায়। কুড়িগ্রামে যৌথবাহিনীর আর্টিলারি হামলায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শহর ছেড়ে যায়।
এদিন নোয়াখালী, শেরপুর ও গোপালগঞ্জ হানাদারমুক্ত হয়। গোপালগঞ্জে ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুর জন্মভূমিতে পতাকা উত্তোলন করেন। চুয়াডাঙ্গায়, মিত্রবাহিনী প্রবেশ করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা চুয়াডাঙ্গা–আলমডাঙ্গা ছেড়ে কুষ্টিয়ার দিকে পালিয়ে যায়। মংলা–সুন্দরবন অঞ্চলে, মেজর এম এ জলিল ও মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে ৯ নম্বর সেক্টর বিশাল এলাকা মুক্ত করে।
৭ ডিসেম্বরের এসব অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করে যে পাকিস্তানি বাহিনী এখন পরাজয়ের মুখে, আর রাজধানী ঢাকার পতন কেবল সময়ের অপেক্ষা।