রাশিয়ান গমের বাজারমূল্য কম থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলনামূলক বেশি দামে গম কিনছে বাংলাদেশ সরকার। কারণ হিসেবে সরকার বলছে, দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য চুক্তি রক্ষা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি সুবিধা ধরে রাখার বিষয়টিকেই তারা অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের গমের দাম প্রতি টনে ৩০৮ ডলার, যেখানে রাশিয়ান গমের দাম মাত্র ২২৬ থেকে ২৩০ ডলার। অর্থাৎ প্রতি টনে প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ ডলারের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সরকার মার্কিন গমকেই বেছে নিয়েছে।
শনিবার (২৬ অক্টোবর) চট্টগ্রাম বন্দরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা ৫৭ হাজার টন গমের প্রথম চালান এসে পৌঁছেছে। এটি ৪ লাখ ৪০ হাজার টন গম কেনার অংশ, যা চলতি বছরের শুরুতে খাদ্য অধিদপ্তর ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি দপ্তরের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় কেনা হচ্ছে।
সরকার বলছে, এটি শুধু খাদ্য নিরাপত্তা নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামগ্রিক বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের অংশ। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি বাজার রক্ষা করা, যা এ বছর শেষে ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।”
তবে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এই ‘কূটনৈতিক বিবেচনা’ সাধারণ জনগণের জন্য আর্থিকভাবে ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার চাপে থাকা বাংলাদেশ এখন তুলনামূলক বেশি দামে গম কিনে সরকারি ব্যয়ের চাপ আরও বাড়াচ্ছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ান গমের তুলনায় মার্কিন গমে প্রোটিনের পরিমাণ ও মান বেশি, তবে মূল্য ব্যবধান এতটাই বড় যে সেটি অনেক ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা হারায়। বাণিজ্য সচিবও স্বীকার করেছেন, “রাশিয়ার গমে ১২ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায় পোকা ও আর্দ্রতার কারণে।” তবে সমালোচকদের মতে, এই যুক্তি পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ অন্যান্য দেশগুলো কম দামে একই উৎস থেকে গম আমদানি করে যাচ্ছে।
চুক্তির আওতায় সরকার ৩৫ লাখ টন গম আমদানিতে সম্মত হয়েছে, যার খসড়া উভয় পক্ষই ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে। শুধু আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর বাকি আছে।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, “আমরা দামের প্রতিযোগিতা বিবেচনা করেই গম কিনি, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গমের মান তুলনামূলক ভালো।”
তবে তিনি জানান, বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো রাশিয়া, ব্রাজিল ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানিতে আগ্রহী, কারণ দাম সেখানে অনেক কম। তার মতে, “সরকার চাইলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনাকাটার পাশাপাশি বিকল্প উৎসও বিবেচনা করতে পারত।”
অর্থনীতিবিদদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত কৌশলগত হলেও বাস্তবে তা বাণিজ্য ঘাটতি ও ব্যয় বৃদ্ধি করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়াসে খাদ্য আমদানি খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করার এই নীতি সাধারণ নাগরিকের জন্য নতুন চাপ তৈরি করতে পারে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বছরে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, আর আমদানি করে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। সরকারের লক্ষ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমানো হলেও প্রশ্ন উঠেছে তার খেসারত কি জনগণকেই দিতে হবে?