সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে এক ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ঘোষণা করেছে। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭-সদস্য পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই রায় দেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন: বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান এবং বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
রায়ে আপিল বিভাগ ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা পুনর্ব্যক্ত করে জানায়, ১৯৯৬ সালে এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। আদালত এটিকে বৈধ ঘোষণা করায়, আইনগতভাবে আবারও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সক্রিয় হবে। তবে তা চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে কার্যকর হবে — অর্থাৎ আগামী ছয় বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়ন হবে না।
আপিল বিভাগ জানিয়েছে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে, এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হবে পরবর্তী নির্বাচন (চতুর্দশ সংসদ) থেকে। আদালত এই সিদ্ধান্তে বলেছে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারই আগামী সম্ভাব্য নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে।
বিএনপিসহ আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছিল যে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল স্পষ্ট, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। এই দাবিকে কেন্দ্র করেই তারা বছরের পর বছর আন্দোলন, কর্মসূচি, এমনকি রাজনৈতিক সমঝোতার টেবিলেও কঠোর অবস্থান ধরে রেখেছে।
কিন্তু এবার তাদের সমর্থনের অন্তর্বর্তী সরকারের বিচার বিভাগ এমন এক রায় দিয়েছে যা বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর জন্য এক ধরনের শাঁখের করাত হয়ে দেখা দিয়েছে। একদিকে ত্রয়োদশ সংশোধনী বৈধ ঘোষণা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা হয়েছে যা তাদের বহুদিনের রাজনৈতিক দাবি। কিন্তু অন্যদিকে এই ব্যবস্থাটি তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না; এটি কার্যকর হবে ছয় বছর পর। অর্থাৎ পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই হবে।
ফলে বর্তমান আপাত ক্ষমতাসীন দলগুলোর জন্য পরিস্থিতি কিছুটা অস্বস্তিকর। একদিকে তারা বলতে পারে যে আদালত তাদের দাবিকে বৈধতা দিয়েছে। অন্যদিকে বাস্তবতা হলো—রায় কার্যকর হতে দেরি হওয়ায় আগামী নির্বাচনে তাদের আগের অভিযোগ বা আন্দোলনের জন্য যে যুক্তি ছিল, সেটির মুখে চপেটাঘাত দিয়ে দিল ইউনূস সরকার।
রাজনৈতিকভাবে এটি এমন একটি অবস্থার জন্ম দিয়েছে যাকে অনেকেই বলছেন, না গিলতে পারছে, না হজম করতে পারছে। দাবি মেনে নেওয়া হলেও সুবিধাটি এখনই তাদের হাতে আসছে না।
সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এই রায় ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নির্বাচন-ব্যবস্থা নিয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, তবে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর যেমন দাবী পূরণ হল, তেমনি একটি কৌশলগত অনিশ্চয়তাও তৈরি হলো। তারা কি এই রায় মেনে নেবে? নির্বাচন কি ড. ইউনূস ঘোষিত যথাসময়ে হবে?
বিগত দশক ধরে “তত্ত্বাবধায়ক সরকার” নামে যেভাবে তারা গর্জন করেছেন, আজ সেই গর্জন যেন নিজেই তাদের গলায় ফাঁসের গাঁথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্লেষাত্মক প্রশ্নটা তো অনিবার্য— এবার নিশ্চয়ই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে?