বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার মনে করেন, আজ হোক বা ৫০ বছর পর, বড় ভূমিকম্প আসবেই। তবে জনগণের সচেতনতার অভাব, সরকারের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে এ ঝুঁকি এখন বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়, আগাম সংকেতও দেওয়া যায় না। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব যদি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে জনগণকে সচেতন করতে হবে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং নিয়মিত মহড়া চালু করতে হবে।
সম্প্রতি কয়েক দফা ভূমিকম্পে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ও অপতথ্য ছড়ানো আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। “আজকাল সবাই ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন। ফলে সাধারণ মানুষ ও নীতি নির্ধারকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।”
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে দীর্ঘ গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে দুটি বড় ভূমিকম্পের উৎস রয়েছে। একটি হলো উত্তরের ডাউকি ফল্ট, যা ময়মনসিংহ, শেরপুর, সুনামগঞ্জ হয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত। অতীতে এ ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছে—১৮৯৭ সালের গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক ছিল ৮.৩ মাত্রার। আরেকটি উৎস হলো পূর্বাঞ্চলের সাবডাকশন জোন, যা সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে ইন্ডিয়ান প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে ঢুকে যাচ্ছে।
অধ্যাপক আখতার বলেন, উৎস দূরে হলেও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোড না মানা—সব মিলিয়ে রাজধানী সবচেয়ে ঝুঁকিতে। তিনি বলেন, “মাশরুমের মতো ভবন তৈরি হয়েছে, ওপেন স্পেস নেই, জরুরি সেবা দূরে। বিল্ডিং কোডও যথাযথভাবে মানা হয়নি।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, ঢাকায় ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। তাৎক্ষণিকভাবে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। উদ্ধার না পেয়ে আরও অনেক মানুষ মারা যেতে পারে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগে আগুন লাগতে পারে, খাদ্য ও পানীয়ের অভাবে মানুষ আটকা পড়তে পারে।
তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ভূমিকম্প হলে কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে হবে, তা মানুষ জানে না। সরকারেরও পরিকল্পনা নেই। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে দেখা গেছে, আতঙ্কে মানুষ ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে, অনেক আহত হয়েছে।
আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূমিকম্প সতর্কীকরণ প্রকল্প ছিল, কিন্তু তহবিলের অভাবে তা বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন করে প্রকল্প চালু হবে। তবে সরকারি পর্যায়ে ভূমিকম্পকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। ২০০৮ থেকে ২০১১ সালে কম্প্রিহেনসিভ ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম হয়েছিল, কিন্তু তার ফলোআপ হয়নি।
তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা যদি পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেন, তবে মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা দেশপ্রেমের বিষয়। অর্থনীতি ও উন্নয়নও এর সঙ্গে জড়িত।
ভূমিকম্পবিদ্যার তিনটি শাখার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন—আর্থকোয়েক জিওলজি, আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং ও আর্থকোয়েক ফিজিক্স। পরিকল্পনা প্রণয়নে এ তিন বিভাগের বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার মনে করেন, ভূমিকম্প ঠেকানো সম্ভব নয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। এজন্য সচেতনতা, সঠিক বিল্ডিং কোড, পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সরকারের প্রস্তুতি জরুরি। অন্যথায় বড় ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে।