দেশের প্রথম নদীভিত্তিক কন্টেইনার টার্মিনাল পানগাঁও বন্দর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সুইজারল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি মেডলগ এসএ-কে দায়িত্ব দিতে গিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিয়মনীতি উপেক্ষা করেছে। দেশীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং সীমিত দরপত্র আহ্বান করে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠানকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, শুরু থেকেই বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার জন্য প্রক্রিয়া সাজানো হয়েছিল। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার জন্য সুইজারল্যান্ডে ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে বলেও তথ্য এসেছে।
৬ নভেম্বর টেকনিক্যাল ইভালুয়েশন এবং ৯ নভেম্বর ফিন্যান্সিয়াল ইভালুয়েশন দ্রুত সম্পন্ন করে কেবল মেডলগ এসএকে যোগ্য ঘোষণা করা হয়। ১৭ নভেম্বর টার্মিনালের দায়িত্ব তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দিন ধার্য করা হয়েছে।
দেশীয় প্রতিষ্ঠান এইচআর লাইনও টেন্ডারে অংশ নেয়। তবে জানা গেছে, তাদের অংশগ্রহণ ছিল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ মেডলগ এসএ’র মূল মালিকানা প্রতিষ্ঠান এমএসসি-র বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সাবের হোসেন চৌধুরীর আরেকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ফলে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যত বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোটস এসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, “সরকারকে ঘিরে থাকা একটি লুটেরা শ্রেণি বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দিচ্ছে। এটি দেশদ্রোহিতা ছাড়া আর কিছু নয়।”
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সদস্য আবদুল মাহবুব চৌধুরী বলেন, “বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দেওয়া ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমানে বন্দরে পণ্য খালাসে খরচ হচ্ছে ৬৬৫ টাকা, যা শতকরা হিসেবে ১২১ শতাংশ।”
পানগাঁও টার্মিনাল ঢাকার কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত। ২০২৩ সালে এখানে ২৯ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময়ে কার্যক্রম কমতে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর ও শুল্ক বিভাগের অদক্ষতার কারণে টার্মিনালটি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২২ বছরের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে বন্দরের দায়িত্ব দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে সক্ষম হলেও তাদের সুযোগ দেওয়া হয়নি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) অনুযায়ী অন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে ডকুমেন্ট সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন কোনো মন্তব্য করতে চাননি।
পানগাঁও কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে দেশীয় ব্যবসায়ী ও সংগঠনগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা মনে করছেন, অস্বচ্ছ টেন্ডার প্রক্রিয়া ও স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিদেশিদের হাতে চলে যাচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্বের জন্য বড় হুমকি।