সর্বশেষ

নাফ নদে আরাকান আর্মির দৌরাত্ম্য

শত শত জেলে অপহৃত, সীমান্তে নতুন করে আতঙ্ক

জেলা প্রতিনিধি কক্সবাজার
প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:০০
শত শত জেলে অপহৃত, সীমান্তে নতুন করে আতঙ্ক

বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্তের নাফ নদ আজ আতঙ্কের প্রতীক। প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে এ নদে নামতে হয় বাংলাদেশি জেলেদের। কিন্তু দিন শেষে অনেকেই আর ঘরে ফিরতে পারছেন না। মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন আরাকান আর্মি সীমা লঙ্ঘনের অজুহাতে নিয়মিতভাবে তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এতে সীমান্তবর্তী পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছে।

 

প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৫ থেকে ২৮ আগস্টের মধ্যে ২৩ দিনে অন্তত ৬৯ জন জেলেকে ধরে নিয়ে গেছে আরাকান আর্মি। ১৭ আগস্ট ৯ জন, ২৩ আগস্ট ১২ জন, ২৪ আগস্ট ১৪ জন, ২৫ আগস্ট ৭ জন এবং ২৬ আগস্ট আরও ১৩ জনকে অপহরণ করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রলারসহ আরও ১৪ জেলে আটক হয়। এর আগে ১২ সেপ্টেম্বর ৫টি ট্রলার থেকে ৪০ মাঝিমাল্লাকে ধরে নিয়ে যায় তারা। যদিও একটি ট্রলারের ১৭ জন জেলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। বর্তমানে তাদের হাতে অন্তত ১১৪ জন জেলে বন্দি রয়েছে। এছাড়া ১৯টি ট্রলারও আটক করা হয়েছে। এর আগে জুন পর্যন্ত প্রায় ১৬৫ জন জেলে অপহৃত হয়েছিল। কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় কিছু মুক্তি পেলেও এখনো বহু পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

 

সীমান্তবাসীর প্রশ্ন—এভাবে আর কতদিন চলবে? ইতিহাসে এর আগেও নাফ নদকে ঘিরে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। ২০০০ সালে মিয়ানমার সেনাদের আগ্রাসী ভূমিকায় ‘নাফ যুদ্ধ’ সংঘটিত হয়, যেখানে বাংলাদেশ সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল এবং মিয়ানমারকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। এখন যখন একের পর এক জেলে অপহৃত হচ্ছে, তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—শুধু কূটনৈতিক প্রতিবাদে কি সমস্যার সমাধান সম্ভব? নাকি অতীতের মতো এবারও কঠোর বার্তা দিতে হবে?

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, নাফ নদকে ঘিরে আরাকান আর্মির কর্মকাণ্ড শুধু সীমান্ত সমস্যা নয়; এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও গুরুতর হুমকি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সীমান্ত নদীতে শান্তিপূর্ণ চলাচলের অধিকার থাকা সত্ত্বেও তারা কার্যত একটি ‘গোপন নিষেধাজ্ঞা’ জারি করেছে। রাখাইন রাজ্যে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তারা জেলেদের টার্গেট করছে।

 

কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার সালাউদ্দিন রশিদ তানভির বলেন, “বেশির ভাগ জেলে মাছ ধরতে গিয়ে ভাটার সময় মিয়ানমারের সীমানায় ঢুকে যায়, তখনই তাদের আটক করা হয়। তবে বাংলাদেশের জলসীমায় আরাকান আর্মি এসে কাউকে ধরে নিয়ে যাবে, তা হতে দেব না।”

 

কক্সবাজার রামুর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মহিউদ্দিন জানান, “আরাকান আর্মি সরাসরি মাদক ও মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ কঠিন হয়ে পড়েছে কারণ মিয়ানমারে এখন কার্যত কোনো সরকার নেই। তারপরও আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে বাংলাদেশের জেলেদের ফেরত আনা যায়।”

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্তে এই পরিস্থিতি শুধু মানবিক নয়, কূটনৈতিক ও সামরিক নিরাপত্তার জন্যও বড় সংকেত। এখনই কূটনৈতিক চাপ বৃদ্ধি, সীমান্ত পাহারা জোরদার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা না চাইলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।

 

নাফ নদ, যে নদ একসময় বাংলাদেশের গৌরবগাথা লিখেছিল, আজ হয়ে উঠেছে শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার প্রতীক। জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন রাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সব খবর