বাংলাদেশের মানুষ কিংবা সংবাদমাধ্যম কেন মুহাম্মদ ইউনূস বা আলী রীয়াজের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলতে ভয় পায় এমন প্রশ্ন তুলেছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও ব্রডকাস্টার জিয়া হায়দার রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা কেবল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ফল নয়, বরং এর শিকড় সমাজ ও সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত।
মঙ্গলবার বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রহমান সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত ‘সাহিত্যের রাজনীতি’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি বলেন, “এখানে রাজনৈতিকভাবে অন্ধ ব্যক্তিরা রাজনৈতিকভাবে অদক্ষ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।” বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সিদ্ধান্ত নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ লেখক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় দমন যেমন আছে, তেমনি সমাজ ও করপোরেট সংস্কারই মানুষকে নীরব থাকতে বাধ্য করছে।”
তিনি বলেন, “আমরা কেন প্রকাশ্যে বলতে পারি না যে আলী রীয়াজ ব্যর্থ হয়েছেন, বা অধ্যাপক ইউনূস আমাদের হতাশ করেছেন? তারা নির্বাচিত রাজনীতিক নন, তবুও সমালোচনার বাইরে থেকে গেছেন। এই ভয় ও নীরবতা আমাদের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত।”

জিয়া হায়দার দাবি করেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম অন্তর্বর্তী সরকারকে যথাযথভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে। “প্রধান উপদেষ্টা সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে চান না। অথচ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গঠনে নেতাদের নিয়মিত সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের জবাব দেওয়া উচিত,” বলেন তিনি।
তিনি উল্লেখ করেন, “অধ্যাপক ইউনূস তার পুরো মেয়াদে দেশের সাংবাদিকদের সামনে খোলা প্রশ্নোত্তরে আসেননি। ভয়েস অব আমেরিকা ও জিটিওকে দেওয়া দুটি সাক্ষাৎকার ছাড়া তাকে কোথাও দেখা যায়নি। সেখানে কঠিন প্রশ্নের মুখে তিনি বিপর্যস্ত হয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম সে বিষয়ে কোনো আলোচনা তোলেনি।”
নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন জিয়া হায়দার। তিনি বলেন, “জাতীয় সনদ সইয়ের ছবিতে ৪৭ জনের মধ্যে মাত্র একজন নারী ছিলেন। নারী কমিশনের প্রধান শিরীন হক প্রকাশ্যে আক্রমণের মুখে পড়লেও ইউনূস কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেননি। আলী রীয়াজও নারী কমিশনের সুপারিশকে গুরুত্ব দেননি।”
তিনি মনে করেন, “প্রধান উপদেষ্টার নীরবতা পুরো সমাজে নীরবতার সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রেখেছে। তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো ভালো নজির স্থাপন করতে পারেননি।”
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে তিনি আরও বলেন, “এখানে সংবাদমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক চাপের পাশাপাশি করপোরেট নিয়ন্ত্রণও কাজ করে। অনেক সাংবাদিক নিজের নাম প্রকাশ না করে ‘নিজস্ব প্রতিবেদক’ নামে লিখেন, কারণ নিরাপত্তা নেই।”
তার মতে, “প্রধান উপদেষ্টা যদি নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিতেন, তাহলে গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠত। তিনি নৈতিকভাবে উঁচু কোনো স্থানে উঠতে পারতেন, কিন্তু সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছেন।”
জিয়া হায়দার আরও যোগ করেন, “এখন আমরা এমন এক অবস্থায় আছি, যেখানে রাজনৈতিকভাবে অন্ধ ব্যক্তিরা রাজনৈতিকভাবে অদক্ষ ব্যক্তিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরই পরিণতি দেখা গেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রহসনের মধ্য দিয়ে।”
‘ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো’ উপন্যাসের লেখক জিয়া হায়দার রহমান ২০১৪ সালে জেমস টেইট ব্ল্যাক মেমোরিয়াল পুরস্কার পান। যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও তিনি নিয়মিত বাংলাদেশে এসে নানা সাহিত্য ও চিন্তাবিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন।