বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগোতে গিয়ে জনমনে এক অদৃশ্য, কিন্তু স্থির অস্থিরতার ছাপ দেখা দিয়েছে। নাগরিকরা ভোটার হতে চাইলেও সেই সঙ্গে ভীত—“ভোট দিতে যাওয়ার সময় মবের শিকার হবো কিনা?”—এমন প্রশ্নের উত্তর এখনও অনিশ্চিত। নাগরিক প্ল্যাটফরম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক এবং অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য উল্লেখ করেছেন, নির্বাচন এখন একটি অবধারিত বিষয় হলেও গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে শঙ্কা কাটছে না।
চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় অনুষ্ঠিত ‘আঞ্চলিক পরামর্শ সভা’-তে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, “নির্বাচনের পক্ষে প্রায় সবাই আছেন। রাজনৈতিক দল, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, নাগরিক সমাজ, সেনাবাহিনী এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ভোটের আয়োজন চান। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বজায় রেখে এক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নিয়ে জনগণের শঙ্কা দূর হয়নি।”
এই শঙ্কার মূল কারণ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সম্প্রতি মব-সন্ত্রাস, ভাঙচুর এবং স্থানীয়ভাবে সহিংসতার ঘটনাগুলি বেড়েছে। ভোটের আগে এসব ঘটনা ভোটারদের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করছে। সভায় অংশ নেওয়া শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, নারী অধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী, শিক্ষার্থী ও তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধিরা এই ভয়ের কথাই তুলে ধরেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, “নাগরিকেরা সুশাসন, আইনের শাসন, নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করার প্রত্যাশা জানিয়েছেন। তারা চায় দক্ষ প্রশাসন, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং নিরপেক্ষ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। কিন্তু এই কাঠামো কার্যকর না হওয়ায় ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে নিরাপদভাবে উপস্থিত হতে উদ্বিগ্ন।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কারেও অগ্রগতি কম। দেড় বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা ও দুর্নীতিমুক্ত থাকার বিষয়ে কোনো বড় অগ্রগতি দেখা যায়নি। মানুষের মধ্যে হতাশা রয়েছে, কারণ সরকারি ঘোষণার পরও রাজনৈতিক নেতাদের আয়-ব্যয় ও সম্পদের স্বচ্ছ হিসাব প্রকাশ করা হয়নি।
সভায় বক্তারা বলেন, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক নেতাদের পরিবারের সহায়-সম্পত্তির বিষয়ে স্বচ্ছতা আনয়ন অত্যন্ত জরুরি। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে জনপ্রতিনিধিদের জনগণের সামনে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে।”
ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মোহাম্মদ নাজিমুদ্দিন সভায় বলেন, “ভোট দিতে যাওয়ার সময় মবের শিকার হবো কিনা—এটি একটি বাস্তব উদ্বেগ। মানুষ এই আশঙ্কার কারণে ভোটকেন্দ্রে নির্ভয়ে যেতে পারছে না।” এই মন্তব্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিদ্যমান আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার প্রতিফলন।
নাগরিকদের এই আশঙ্কার পেছনে রয়েছে সরকারের ব্যর্থতা। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপ্রতুল প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব ভোট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতাকেও প্রভাবিত করছে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সভায় আরও বলেন, “নাগরিকরা নির্বাচন কমিশন ও সরকারের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করছেন। সুষ্ঠু নির্বাচন, দুর্নীতি দমন, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে এখনই পদক্ষেপ প্রয়োজন।”
এছাড়া, পরামর্শ সভায় শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান বলেন, নাগরিকদের অধিকারসচেতন হতে হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে। এই প্রক্রিয়া না থাকলে ভোট সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত হলেও জনগণের আস্থা তৈরি হবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচনকে শুধুমাত্র সময়ে আয়োজন করলেই হবে না, এটি হতে হবে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য। মব সন্ত্রাসের ভয়, সরকারের ব্যর্থতা ও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে নাগরিকদের মধ্যে অস্থিরতা বেড়ে গেছে। তাই রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে এখনই দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে, নয়তো দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া জনমনের আস্থা হারাতে পারে।
শেষপর্যন্ত, চট্টগ্রামের এই আঞ্চলিক পরামর্শ সভা তুলে ধরেছে, নাগরিকেরা নিরাপদ ভোট, জবাবদিহি, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং স্বচ্ছ নির্বাচন চায়। কিন্তু এই প্রত্যাশা পূরণ না হলে ভোটের সময় মব-সন্ত্রাস ও অস্থিরতার কারণে জনগণের অংশগ্রহণ কমতে পারে। তাই সরকারের দায়িত্ব এখন সময়মতো নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা, যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হয় এবং নাগরিকদের আস্থা পুনঃস্থাপন হয়।