ব্যবসা ও ব্যক্তিগত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে দুইবার থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন মামুন চৌধুরী। কিন্তু তৃতীয়বার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি বিস্মিত। কারণ জানার সুযোগও পাননি। শুধু মামুন নন, সাম্প্রতিক সময়ে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, মিসরসহ বহু দেশে বাংলাদেশিদের ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। পর্যটন, উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে যেতে চাওয়া হাজারো বাংলাদেশি এখন ভিসা জটিলতায় বিপাকে।
পর্যটন ব্যবসায় জড়িত একাধিক ব্যক্তির মতে, গত দুই-আড়াই বছরে ভিসা জটিলতা বেড়েছে, বিশেষ করে গত এক বছরে প্রত্যাখ্যানের হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক দেশেই এখন অতিরিক্ত যাচাই-বাছাই করে ভিসা দেওয়া হচ্ছে, আবার কিছু দেশে ভিসা সম্পূর্ণ বন্ধ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ভারত সব ধরনের ভিসা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে সীমিত আকারে চিকিৎসা ও ডাবল এন্ট্রি ভিসা চালু আছে। তবে ভারতের ভিসা না পাওয়ার প্রভাব পড়েছে ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোতে। কারণ, এসব দেশের দূতাবাস দিল্লিতে অবস্থিত এবং সশরীরে ইন্টারভিউ দিতে হয়। ফলে ভারতীয় ভিসা না থাকলে ইউরোপের অনেক দেশের ভিসা আবেদনই অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি বেলজিয়ামও ঢাকার সুইডেন দূতাবাস থেকে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আবেদনকারীদের দিল্লিতে গিয়ে ভিএফএস সেন্টারে কাগজপত্র জমা দিতে হচ্ছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৯টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ভিসা সেন্টার ঢাকায় স্থানান্তরের প্রস্তাব দেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, বুলগেরিয়া ইতিমধ্যে তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে সরিয়েছে। তবে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত বা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বিকল্প ব্যবস্থাও কার্যকর হচ্ছে না।
২০১২ সালে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির অভিযোগে সংযুক্ত আরব আমিরাত বাংলাদেশিদের জন্য সব ধরনের ভিসা বন্ধ করে দেয়। বর্তমানে শুধু স্কিল বা হাইপ্রোফাইল ভিসা চালু আছে। ভিজিট ভিসা থেকে কাজের ভিসায় রূপান্তরের সুযোগও বন্ধ। আমিরাত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা না করলেও অনলাইনে আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
এক ফেসবুক পোস্টে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী জানান, “আমিরাতে অবস্থান সংক্রান্ত নিয়ম ভাঙার ২৫ শতাংশের বেশি ঘটনা বাংলাদেশিদের দ্বারা ঘটে।”
পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভিসা জটিলতা মূলত দুই ধরনের—ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ন্ত্রণ এবং কাজের ভিসা বন্ধ। ভুয়া কাগজপত্র, অতিরিক্ত অবস্থান, তৃতীয় দেশে চলে যাওয়ার প্রবণতা এসব সমস্যার মূল কারণ। ট্রাভেল ব্যবসায়ী ফারুক হাসান বলেন, “মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম—সব দেশই এখন কঠোর। ইউরোপের ভিসা রেশিও-ও ভালো নয়।”
ঢাকার থাই দূতাবাস ভুয়া কাগজে ভিসা আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করেছে। মিসর অন-অ্যারাইভাল ভিসা দিলেও যুক্ত করেছে কঠোর শর্ত—ব্যাংকে ৫ হাজার ডলার, বৈধ ভিসা, রিটার্ন টিকিটসহ নানা নিয়ম।
আরব আমিরাত ছাড়াও বাহরাইন, মালয়েশিয়া, ইতালি, ওমানসহ বহু দেশে বাংলাদেশিদের কাজের ভিসা বন্ধ বা সীমিত। মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেট দুর্নীতির কারণে ২০২৩ সালে শ্রমবাজার বন্ধ হয়। ইতালিতে জাল নথির কারণে ওয়ার্ক পারমিট স্থগিত। ওমান কিছু শ্রেণিকে অব্যাহতি দিলেও সাধারণ শ্রমিকদের জন্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা বহাল।
বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সংকট এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। সমাধানে প্রয়োজন কূটনৈতিক উদ্যোগ, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, এবং আন্তর্জাতিক আস্থার পুনর্গঠন। না হলে ভ্রমণ, শিক্ষা ও শ্রমবাজারে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হবে।