সর্বশেষ

মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন ‘কিলো ফ্লাইট’-এর সদস্য ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ আর নেই

প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০০
মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন ‘কিলো ফ্লাইট’-এর সদস্য ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ আর নেই

একাত্তরের আকাশযুদ্ধের বীর সেনানী, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’-এর অন্যতম সদস্য এবং বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ আর নেই। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সকাল ৮টায় রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।

 

তার ছেলে ক্যাপ্টেন তাপস আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন। বিকেল পৌনে ৫টায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি বাশারে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এসময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। 

 

এছাড়া, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তার মরদেহ ফরিদপুরের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে।

 

মুক্তিযুদ্ধের আকাশযুদ্ধে এক কিংবদন্তি নাম

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) একজন বাঙালি বৈমানিক। সে সময় বেসামরিক পাইলটদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন, যাদের মধ্যে সাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন যা বেসামরিকদের মধ্যে একটি বিরল সম্মান।

 

বাঁ থেকে ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এইচ সি দেওয়ান, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিংলা, এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর উত্তম।

 

১৯৬৮ সালে পিআইএতে যোগদানের পর প্রশিক্ষণের জন্য করাচিতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষপাতমূলক আচরণে ক্ষুব্ধ হন এই তরুণ বৈমানিক। পিআইএর ৩০০ পাইলটের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র ৩০ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা আন্দোলন তাকে অনুপ্রাণিত করে, এবং তখন থেকেই বাঙালি বৈমানিকদের নিয়ে আলাদা সংগঠন গঠনের চিন্তা শুরু করেন তিনি।

 

কিন্তু পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতায় সেই সংগঠন গঠনে বাধা দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে তারা প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পাইলট অ্যাসোসিয়েশন’। সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন আলমগীর। দুর্ভাগ্যবশত, ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাপ্টেন আলমগীরসহ তিনজন বাঙালি বৈমানিককে হত্যা করে।

 

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত

 

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই সাহাবুদ্দিন আহমেদ যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি নেন। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। ২৭ মার্চ কারফিউ ওঠার পর পরিবারকে বিক্রমপুরের রায়পাড়ায় রেখে কুষ্টিয়া হয়ে ভারতের সীমান্তে পৌঁছান তিনি।

 

ভারতের কলকাতায় আশ্রয় নেওয়ার পর ভারতীয় সাংবাদিক ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তাদের সহায়তায় তিনি বাংলাদেশের পাইলটদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। পরে তিনি যোগ দেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রাথমিক গঠন প্রক্রিয়ায়, যা পরিচালিত হচ্ছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ও এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার-এর তত্ত্বাবধানে।

 

‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’: ইতিহাস বদলে দেওয়া আক্রমণ

 

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে ভারতের দিমাপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। সে সময় মোট ৯ জন পাইলটের মধ্যে ৬ জনই ছিলেন বেসামরিক; তাদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ। তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় যুদ্ধের উপযোগী করে তোলা কয়েকটি সাধারণ বিমান, যার মধ্যে ছিল একটি ড্যাকোটা, একটি অটার ও একটি ফ্রেঞ্চ হেলিকপ্টার।

 

বাঁ থেকে এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রামাকৃষ্ণান, ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার সঞ্জয় কুমার চৌধুরী, ফ্লাইং অফিসার বদরুল আলম বীর উত্তম, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সি এম সিংলা।

 

মাত্র কয়েকশ ফুট উচ্চতায় বিপজ্জনক প্রশিক্ষণ শেষে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে নামার প্রস্তুতি নেন। অবশেষে ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’।

 

সেদিন হেলিকপ্টার নিয়ে সাহাবুদ্দিন আহমেদ ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে পাকিস্তানি বিমানবাহিনীর জ্বালানি ডিপোতে আক্রমণ চালান। একই সময়ে চট্টগ্রামে অটার বিমান নিয়ে আরেকদল যোদ্ধা তেল সরবরাহ কেন্দ্র ধ্বংস করে দেন। এই সমন্বিত অভিযানে পাকিস্তান বিমানবাহিনী কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

এর পর ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে হামলা শুরু করে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলার আকাশ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।

যুদ্ধের সময় হেলিকপ্টার নিয়ে অন্তত ৫০টি আক্রমণে অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন, যার মধ্যে ১২টি অভিযানে তিনি সরাসরি নেতৃত্ব দেন।

 

যুদ্ধশেষের বছরগুলো ও স্মৃতিচারণ

 

স্বাধীনতার পরও তিনি বিমান চলাচল ও প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৭ সালে এক সাক্ষাৎকারে সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন,

 

“যুদ্ধের সময় মৃত্যু ভয় ছিল না। নিরীহ মানুষকে রক্ষা করা আর দেশমাতাকে বাঁচানোই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য।”

 

তার জীবন ছিল এক সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের প্রতিচ্ছবি যিনি বাণিজ্যিক বিমানচালক থেকে একাত্তরের মুক্ত আকাশের যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন।

 

তার মৃত্যুতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষক ও সহযোদ্ধারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এক বিবৃতিতে জানিয়েছে,

 

“ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের আকাশযুদ্ধের পথিকৃৎ। তার অবদান স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”

সব খবর

আরও পড়ুন

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ পুলিশের কনটিনজেন্ট প্রত্যাহারের নির্দেশ

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ পুলিশের কনটিনজেন্ট প্রত্যাহারের নির্দেশ

‘জুলাই যোদ্ধা’ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

সংসদ ভবনে উত্তেজনা ‘জুলাই যোদ্ধা’ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে এখন থেকে অনুমতি নিতে হবে বাংলাদেশীদের

শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে এখন থেকে অনুমতি নিতে হবে বাংলাদেশীদের

মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হবে এ মাসেই: ধর্ম উপদেষ্টা

মসজিদ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা হবে এ মাসেই: ধর্ম উপদেষ্টা

গুম মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সেনা আইনে চায় ‘এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন’

গুম মামলায় সেনা কর্মকর্তাদের বিচার সেনা আইনে চায় ‘এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন’

ঢাকা সেনানিবাসের ভবন অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা, রাখা হতে পারে গুমে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের

ঢাকা সেনানিবাসের ভবন অস্থায়ী কারাগার ঘোষণা, রাখা হতে পারে গুমে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ডিসেম্বরেই হোক বইমেলা

প্রকাশকদের প্রস্তাব জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ডিসেম্বরেই হোক বইমেলা

এবার স্থলভাগের গ্যাস ব্লক বিদেশিদের হাতে দেওয়ার তোড়জোড়

এবার স্থলভাগের গ্যাস ব্লক বিদেশিদের হাতে দেওয়ার তোড়জোড়