শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে এবার আগের মতো মানুষের চিরচেনা ঢল দেখা যায়নি। ফুল, ব্যানার আর স্লোগানে মুখর পরিবেশের বদলে ছিল তুলনামূলক শান্ত ও সংযত উপস্থিতি। তবে যারা এসেছেন, তাদের কণ্ঠে ছিল একাত্তরের অসমাপ্ত আকাঙ্ক্ষা, হতাশা আর নতুন করে সেই চেতনা লালনের প্রত্যয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী পরিকল্পিতভাবে শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে। পরে রায়েরবাজারে পাওয়া যায় তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। সেই স্থানই আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী বধ্যভূমি।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সেখানে হাজির হন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ ফুল দিয়ে, নীরবতা পালন করে স্মরণ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের।
দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, “আমাদের দেশটা বিনা মূল্যে পাওয়া নয়—এই বোধটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে জাগিয়ে তুলতেই সন্তানদের নিয়ে এসেছি।” তবে অন্য বছরের তুলনায় আয়োজন ও মানুষের উপস্থিতি কম থাকায় তিনি হতাশাও প্রকাশ করেন। তার ভাষায়, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নার্সিং করা দরকার। বাড়াবাড়ি না হলেও ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই দেশ চালাতে হলে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।”
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মোহাম্মদীয়া আলিম মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মোনাজাতের মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ করেন। একইভাবে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
ডাকসু নেতৃবৃন্দ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট, জুলাই যোদ্ধা সংসদ, বাংলা একাডেমিসহ নানা সংগঠন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রায়েরবাজারে শ্রদ্ধা জানান। সদ্য সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এক মিনিট নীরবতা পালন করে বলেন, স্বাধীনতা অর্জিত হলেও একাত্তরের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তার মতে, ২০২৪ সালের দাঙ্গা ছিল সেই অসমাপ্ত লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতা।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, “চব্বিশের আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা একাত্তরের আকাঙ্ক্ষারই ধারাবাহিকতা।” তিনি বলেন, একাত্তরের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। যারা ২০২৪ ও ১৯৭১-কে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায়, তারা মূলত এই দেশের গণঅভ্যুত্থানের চেতনার বাইরে যেতে চাইছে।
এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভোরে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তারা নীরবে দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান জানান। রাষ্ট্রীয় সালাম ও বিউগলের করুণ সুরের মধ্য দিয়ে দিবসটির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।