হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র। আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও দুর্ঘটনাস্থলের দগদগে ক্ষতচিহ্ন যেন বলছে ভয়াবহতার ইতিহাস। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, ২৭ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে, তবে ধ্বংসস্তূপের ভেতর এখনও তাপ ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে।
রোববার সকালে কার্গো ভিলেজের পাবলিক টয়লেট এলাকায় সামান্য ধোঁয়া দেখা যায়। দুর্ঘটনাস্থলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ফায়ার সার্ভিসের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া মালামাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, ফায়ার সার্ভিসের সরঞ্জাম ও পানি ছিটানো এলাকা জুড়ে ছাই ও গলে যাওয়া স্টিলের কাঠামো।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, বিমানবন্দরসহ দেশের সব বাহিনীর সহায়তায় আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তারা জানায়, "সবাইয়ের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিমানবন্দরের চিত্র এখন স্বাভাবিকের পথে, যদিও ফুটে উঠছে ভয়াবহ আগুনের ক্ষতচিহ্ন।"
অর্থনৈতিক ক্ষতি ও তদন্ত কমিটি গঠন
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দীন জানিয়েছেন, কার্গো ভিলেজে আমদানি করা সব পণ্য আগুনে পুড়ে গেছে। "আমরা এখন খাতভিত্তিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করছি," বলেন তিনি।
রোববার দুপুরে পুড়ে যাওয়া কার্গো কমপ্লেক্স পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, "আগুনের উৎস ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণে তদন্ত চলছে। কারও ব্যত্যয় থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
সরকার ইতোমধ্যে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। একটি আগুনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি ও দায় নির্ধারণ করবে; অন্যটি কার্গো ব্যবস্থাপনা ও অগ্নিনির্বাপণ কাঠামোর ঘাটতি চিহ্নিত করবে।
শেখ বশির উদ্দীন আরও জানান, "আমরা আন্তর্জাতিক তদন্ত করব। যেসব দেশের কর্মকর্তারা অগ্নিনির্বাপণ ও বিমান নিরাপত্তায় অভিজ্ঞ, তাদের সহযোগিতায় পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হবে।"
তিনি বলেন, আগুনের কারণে ২১টি ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। যাত্রী ক্ষতিপূরণের জন্য আগামী তিন দিন অতিরিক্ত ফ্লাইটের সব চার্জ মওকুফ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আগামী সাত দিন ২৪ ঘণ্টা করে কার্গো পণ্য সরবরাহ কার্যক্রম চলবে, যাতে বাণিজ্যে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ঘাটতি ও দুর্বলতা
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায় কিছু ঘাটতি ছিল। কার্গো ভিলেজে প্রটেকশন ও ডিটেকশন সিস্টেম পর্যাপ্ত ছিল না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক কর্মকর্তা বলেন, “যদি কার্যকর ডিটেকশন সিস্টেম থাকত, তাহলে এত বড় ক্ষতি হতো না। প্রিমিয়াম কেপিআইভুক্ত এলাকায় আরও আধুনিক ফায়ার প্রটেকশন সিস্টেম থাকা দরকার।”
বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে স্টিল কাঠামোর কারণে আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক অগ্নিকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে রোববার বিকেলে সচিবালয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির এক জরুরি বৈঠক হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বীর প্রতীক। উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য ও বেসামরিক বিমান পরিবহন উপদেষ্টা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইজিপি, র্যাব ও বিজিবি প্রধানসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
বৈঠকে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড মোকাবিলায় জাতীয় প্রস্তুতি ও দুর্বলতা বিশ্লেষণ করা হয়। জানা যায়, রাজধানীর বেশির ভাগ ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও সেগুলো কার্যকর নয়। সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ডের পর যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছিল যেমন প্রতিবছর মেইনটেন্যান্স অডিট, ফায়ার প্রটেকশন সিস্টেম স্থাপন তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি।
কমিটি ও সময়সীমা
বৈঠক শেষে ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম জানান, স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রধান করে একটি কোর কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, “আগুন লাগতেই পারে, কিন্তু আমাদের সক্ষমতা ও অক্ষমতা যাচাই করতে হবে। আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরির কারণ ও দায় নির্ধারণে তদন্ত প্রতিবেদনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ফায়ার সিস্টেম ছিল, তবে তা পর্যাপ্ত ছিল না। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে প্রস্তুতি জোরদার করা হচ্ছে।”
২৭ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিভলেও ক্ষতির অঙ্ক এখনো অজানা। আন্তর্জাতিক তদন্তের ঘোষণা, দায় নির্ধারণ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি- এসব মিলিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরের অগ্নিকাণ্ড এখন সরকারের জন্য বড় এক পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।